বাংলাদেশের সাহিত্য জগতে রানু হাফিজ একজন সুপরিচিত ও স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব। তার গল্প, কবিতাও উপন্যাসগুলোর সঙ্গে পাঠক পাঠিকার সবিশেষ পরিচয় ঘটেছে ইতিমধ্যেই। তবে তার এই লেখিকা পরিচিতির বাইরেও তিনি বহুবিধ কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত আছেন বহুদিন ধরে।
বিশিষ্ট সমাজসেবী হিসেবে তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয়। অত্যন্ত সফল সংগঠক ও জনহিতৈষী, গোঁড়ামিমুক্ত মনের মানুষ হিসেবে সকলের কাছে তিনি পরিচিত।
বিভিন্ন জনহিতকর প্রকল্পের সাথেও তিনি যুক্ত। স্বল্পভাষী, প্রখর ব্যক্তিত্বময়ী রানু হাফিজ। তার চালিকাশক্তির দ্বারা সংগঠনগুলিকে সফলভাবে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন।
তার গল্প উপন্যাসগুলিতেও আমরা এর প্রতিফলন দেখতে পেয়েছি। দেশহিতৈষণার তাগিদ, নারী শক্তির উত্থান, যাকে দিয়ে যেটুকু হবে তিনি যেন তার প্রখর দূরদৃষ্টি দিয়ে দেখতে পান এবং কাজেও তার সফল রূপায়ণ করে থাকেন।
‘জেসমিন একটি ফুলের নাম’ উপন্যাসটি এক সদ্য কিশোরী বীরাঙ্গনার না বলতে পারা জীবনকথা। দলিত মথিত বঞ্চিত কীটদষ্ট কিশোরীর কুঁড়ি থেকে ফুল হয়ে ওঠার গল্পকথা। একাত্তরের বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়ে এই রকম অনেক জেসমিন আছেন যাদের কথা বর্তমান প্রজন্মের অনেকেরই কাছে অজানা।
অনেক ঝরে পড়া জেসমিনদের মধ্যে একটি ফুলের ছবি এঁকেছেন রানু হাফিজ তার মর্মস্পর্শী কলমে।
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সদ্য বালিকা থেকে কিশোরী হওয়া মেয়েটি পাকবাহিনীর দ্বারা নির্যাতিত হবার পর প্রায় স্তব্ধবাক্ হয়ে পড়ে।
নিজেকে গুটিয়ে নিতে নিতে এক অন্য ভুবনের বাসিন্দা হয়ে যায়। সেখান থেকে সে জেসমিন ফুলে পরিবর্তিত হয় বিদেশী এক দম্পতি রেড্রিক ও নোরার সহমর্মী ও স্নেহশীল সাহচর্যে। জেসমিন ফুল প্রস্ফূটিত হয়ে ধীরে ধীরে পাপড়ি মেলে এবং আরো পরে আমরা দেখি জেসমিন তার সৌরভে সবাইকে ভরিয়ে তোলে । কেউ তার সৌরভ থেকে বঞ্চিত হয় না।
বেশ অনেকগুলি ঘটনার কোলাজ বইটিকে একটা ছবির আকার দেয়; সামাজিক সমস্যাগুলিকে চিহ্ণিত করেও মানুষের আর্তি ও অসহায়তার কথা বলে। চমৎকার আঙ্গিক, বৈচিত্র্যময় প্রেক্ষাপট, সমাজ সচেতক আত্মবোধের মূল্যায়ন, শিক্ষা ও সাহিত্যের ওপর জোর এবং যুক্তিপ্রধান ও তথ্যপূর্ণ উপাদান বইটিকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে।
লেখিকার গদ্য যেমন সাবলীল তেমন বৈচিত্র্যময়। অসম্ভব পরিমিতিবোধ ও বাহুল্যবর্জিত নির্মেদ গদ্য, পরিশীলিত শব্দের ব্যবহার তার লেখাকে একটা মানে উত্তীর্ণ করেছে। অত্যন্ত সংযত কলমে প্রতিটি অনুভূতির প্রকাশ এত জীবন্ত হয়ে উঠেছে, প্রত্যেকটি চরিত্র এবং বিষয়ের পারম্পর্য খুব সুচারুভাবে রক্ষা করেছেন লেখিকা। অনেকগুলি ঘটনা ও চরিত্র একের পর এক এলেও কখনোই তার পারম্পর্য হারায়নি। চরিত্রগুলো সমান মর্যাদা পেয়েছে।
নীলুফার- মন্টি, রেড্রিক- নোরা, উমা-রেদোয়ান, বান্টি- এলিনা, শিরিন আপা, নাসরিন, ছানা, মুনিয়া, জুলি চরিত্রগুলি এত সুন্দর করে এঁকেছেন লেখিকা যে গল্পের থেকে চোখ সরাবার পরেও চরিত্রগুলি চোখের সামনে, মনের মধ্যে ঘোরাফেরা করে।
বাস্তবধর্মী লেখার কারণেই এটা সম্ভব। কোথাও বা এত সুন্দর মনস্তাত্তি¡ক বিশ্লেষণ করেছেন, অনুভূতির বর্ণনা এত জীবন্ত হয়ে উঠেছে যা একটি সংবেদনশীল মন না থাকলে এমন লেখা যায় না।
গল্প যেন নদীর গতি পেয়েছে। পাঠকও সেই স্রোতে ভেসে চলেছেন দেশে ও বিদেশে। কখনও ঢাকা, বিক্রমপুরে, কখনও নিউ ইয়র্কের লং আইল্যান্ডে, লাসভেগাসে। সেখানকার প্রকৃতি, পরিবেশ, ইতিহাস সম্পর্কে ও পাঠককে অবহিত করেছেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার ইতিহাস গল্পকে সমৃদ্ধ করেছে।
উপন্যাসে রেদোয়ান- উমা, জেসমিন – আজাহারের রোমান্টিক সিচুয়েশন তৈরী করেছেন লেখিকা তবে সবই অত্যন্ত পরিশীলিত গদ্যে। কোথাও তা শালীনতার সীমা অতিক্রম করেনি।
নায়াগ্রা জলপ্রপাতকে অনুঘটক হিসেবে ব্যবহার করেছেন চমৎকারভাবে। জলপ্রপাতের বাঁধনহারা জলরাশির প্রত্যক্ষ প্রভাবে জেসমিন ও আজাহারের মনের অর্গল খুলে গেছে, সব কুন্ঠা ভেসে গেছে। চমৎকার পটভূমি সৃষ্টি করেছেন। ঠিক যেন ‘এমন দিনে তারে বলা যায়’।
আবার নারীসমাজের অন্দরমহলের কিছু ছবি শাশুড়ি বৌমার দ্ব›েদ্বর কিছু মুহূর্তও এঁকেছেন।
জেসমিন যেন এক নতুন নারীশক্তির প্রতীক। যে কাউকে রেয়াত করে না। লেখাটা এত বৈচিত্রপূর্ণ। জেসমিন চরিত্রটি একটি উত্তরণের প্রতীক। সে নিজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে, ভাই বোন, আত্মীয়স্বজন সবাইকে উত্তরণের পথ দেখায়। দেশকেও সে ভোলেনা
যেখানে তাঁর শিকড়টি প্রোথিত। জেসমিন যেন একটি ধূপকাঠির মত যে নিজে পুড়ে অপরকে সুগন্ধ বিলিয়ে যায় অকাতরে।
উপন্যাসে সমাজসেবার দিকটি বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করে। নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের নিয়ে জেসমিনের চিন্তা এবং বাস্তবে তার সফল রূপায়ণ একটা দিক নির্দেশ করে। ক্যানসার হাসপাতাল, বৃদ্ধাশ্রম, স্কুল গড়া ও তার পথে নানাবিধ অন্তরায় পরিস্থিতি নানা প্রসঙ্গ সূত্রে এসেছে। কিন্ত কোথাও তিনি নীতিবাগীশ হয়ে ওঠার চেষ্টা করেননি। তার এই লেখার উদ্যোগ আধুনিকতাসঞ্জাত ইতিহাসবোধেরই প্রকাশ। বৈচিত্র্য ও বিভিন্নতার বিপুল সম্ভাবনাকে বাস্তবায়িত করার কথা।
সবকিছু পারস্পরিকতার সূত্র ধরেই তৈরী করেছেন এক চলিষ্ণতার ঐতিহাসিক ও সামাজিক দলিল। লেখিকা রানু হাফিজের এই উপন্যাসটি তার পরিচিতির বয়ানও তৈরি করেছে। এ যেন ইতিহাস ও জীবনের জলছবি।
শমিতা বিশ্বাস।।
প্রবান্ধক ও লেখক
কলকাতা
Leave a Reply