পাভেল আমান।।
প্রাণঘাতী নভেল করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের প্রাদুর্ভাবে রাজ্যের সমস্ত বিদ্যালয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আজ তালা বন্ধ। সেই উদ্ভূত পরিস্থিতিতে শিশুরা হয়ে পড়ছে বাড়ির চার দেওয়ালে বন্দি। যে সমস্ত সু কোমলমতি শিশুদের কলগুঞ্জনে সেই দিবা কালে মুখরিত হয়ে উঠতো স্কুলের আঙ্গিনা সেই স্কুলগুলো আজ করোনার হানায় খা খা করছে। রাজ্যের সমস্ত স্কুলগুলো একেবারেই নীরব-নিস্তব্ধ ভুতুড়ে বাড়িতে পরিণত হয়ে গেছে। কোভিড অতিমারির কারনে পৃথিবী এভাবে পাল্টে যাবে আমরা কখনো কেউ ভাবতে পারিনি। ভারতবর্ষে ১৪ নভেম্বর স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জহরলাল নেহেরুর শিশুদের প্রতি স্নেহ ভালোবাসাকে মর্যাদা ও শ্রদ্ধা জানাতে তার জন্মদিন তাকে জাতীয় শিশু দিবস কবে পালন করা হয়ে আসছে তামাম পৃথিবীতে ২০ নভেম্বর পালিত হয় শিশু দিবস। কিন্তু বিভিন্ন সংবাদপত্র সোশ্যাল মিডিয়ায়, টেলিভিশন মিডিয়ায় প্রত্যক্ষ করছি শিশু নিপীড়নের, ধর্ষণের খবর, যা খুবই উদ্বেগজনক, বেদনাদায়ক ও সামাজিক অবক্ষয়ের উদাহরণ। আজ করোনাকালে গৃহবন্দি শিশুদের নিয়ে আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে, করতে হবে অনেক কিছু বাস্তবিক পরিকল্পনা। কারন তারাই আমাদের আগামীর কান্ডারী ও কর্ণধার। যে শিশুদের সকালে ঘুম থেকে উঠে হাত মুখ ধুয়ে ফ পরিচ্ছন্ন হয়ে, খাবার খেয়ে স্কুল যাওয়া, সেখান থেকে পড়াশোনা শেষ করে বাড়ি ফিরে এসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম, তারপর বিকালে বন্ধুদের সঙ্গে মাঠে দৌড়াদৌড়ি,খেলাধুলা, সন্ধ্যায় আবার রোজনামচা অনুসারে লেখা-পড়ার টেবিলে বসা এবং কিছুক্ষণ টিভি দেখে আবার ঘুমাতে যাওয়া ছিল নিত্যদিনের রুটিন, এসব এখন শিশুদের কাছে বিস্মৃতপ্রায় বা একেবারেই ধীরে ধীরে ইতিহাস হয়ে চলে গেছে শত যোজন দূরে।
করোনার মারণ সংক্রমনের ছোবলে এই সময়ে প্রায় সমস্ত পড়ুয়ারা অনেকটাই চার দেওয়ালের চৌহদ্দিতে ঘরবন্দি হয়ে হাবুডুবু খাচ্ছে। সুকোমল মতি মননে জমছে আশঙ্কার কালো মেঘ। এই সমস্ত শিশুদের ওপর মানসিক চাপ সৃস্টির পাশাপাশি তাদের শারীরিক ও মানসী বিকাশও ক্রমাগত ব্যাহত হচ্ছে বলে সতর্ক করেছেন স্বাস্থ্য ও মানসিক বিশেষজ্ঞরা। বাস্তবিক অর্থে এই শিশুদের জন্য ঘরের মধ্যে লেখাপড়া চালানোর পাশাপাশি আনন্দদায়ক বিভিন্ন খেলা ও সৃজনশীল বিভিন্ন কাজের সুযোগ তৈরি করতে হবে পরিবারকেই। একই সাথে এই অবস্থায় তাদের সাথে পরিবারের সকলের আচার-আচরন অত্যন্ত শিশুসুলভ, সহনশীল, সহানুভূতিশীল নরম ও কোমল হতে হবে যা তাদের মননকে উজ্জীবিত, প্রফুল্লিত, আনন্দিত চিরসবুজ করে তুলতে সাহায্য করবে।এই সময়টায় সারা দিন ঘরের মধ্যে থাকা ছোট শিশুটির সাথে পিতা-মাতা, বড় ভাই বা বোনের উচিৎ তাদের মনের সঙ্গে মিশে গিয়ে শিশু উপযোগী খেলা করা, ছবি আঁকা, আবৃত্তি, গান শিখানো ও শিক্ষামূলক গল্প শোনানো।
স্কুলের পঠন পাঠন বন্ধ থাকায় প্রত্যেক বাবা মাকেই শিক্ষক-শিক্ষিকার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় সঠিকভাবে পড়াশোনা করছে কি না, স্কুলের সিলেবাস অনুযায়ী বাড়ির কাজ, অনুশীলনী কতটুকু এগোচ্ছে-প্রভৃতি নানা বিস্ময়ের উপর সমস্ত অভিভাবকদের অবশ্যই শত ব্যস্ততাতে ও আলোকপাত করতে হবে। কিন্ত শিশুদের পড়াশোনায় অত্যধিক চাপ না দিয়ে তারা যাতে একটু মানসিক বিনোদনেও সময় অতিবাহিত করতে পারে সেদিকেও খেয়াল রাখা একান্ত দরকার। ভুলে গেলে চলবে না অতিমারির এই চরম সঙ্কটের মুহূর্তে বাবা-মায়েরাই তাদের প্রকৃত রক্ষণাবেক্ষণকারী, বন্ধু ও প্রতিপালক।
কোভিড প্রতিকূলতার সময়ে শিশুদের আনন্দদায়ক রকমারি কর্মকান্ডে যুক্ত রাখতে হবে তা না হলে তাদের সুকোমল মতি মননে বাসা বাঁধবে অস্থিরতা, হতাশা, বিপন্নতা। এই সময়ে শিশুদের ওপর এই বন্দি দশার প্রভাবটা বেশি। খেলাধুলা-দৌড়াদৌড়ি, ছুটোছুটি এসবই শিশুদের সহজাত প্রবৃত্তি ও বৈশিষ্ট্য । চার দেওয়ালের মধ্যে আজকে থাকাটা তাদের অন্তঃস্থ শিশুসুলভ আচরণের একেবারে পরিপন্থী। বলপূর্বক তাদের উপর কিছু চাপিয়ে দিলেই এই মুহূর্তে হিতে বিপরীত হয়ে উঠতে পারে। শিক্ষার্থীরা স্কুলে গেলে বন্ধুদের সাথে গল্প গুজব , হইচই, চিৎকার-চেঁচামেচি, ঠাট্টা তামাশা, হাসি মজা আনন্দ করে কিন্তু এই সময়টাতে স্কুল তালা বন্ধ থাকায় তারা তা করতে অপারগ। সুতরাং পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে এই মুহূর্তে শিশুদের প্রতি বাড়তি দায়িত্ব, কর্তব্য, নজর রাখার পাশাপাশি প্রাণঘাতী ভাইরাসের খবরগুলোও যেহেতু শিশুদের মাঝে বেশি ভয়ের সঞ্চার করে তাই এই খবরগুলোকে তাদের কাছ থেকে সুকৌশলে অগোচরে রাখতে হবে। লক্ষ্য করলে বোঝা যায় চার থেকে ছয় বছর বয়সী কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে এর প্রভাবটা খুব বেশি। তাদের অদম্য উৎসাহ জিজ্ঞাসার জন্য। আমাদের উচিৎ হবে তাদের মানসিক দিক থেকে সাহসী, সচেতন, প্রত্যয়ী করে তোলা। শিশুরা যেন নিয়মিত ব্যায়াম, স্বাস্থ্য বিধি, বই পড়ার পাশাপাশি সঠিক সময়ে পরিমিত খাবার গ্রহণ করে সেটিও নিশ্চিত করতে হবে তাদের বিকাশের জন্য।
এই মুহূর্তে পরিস্থিতির কথা মনে রেখে শিশুদের জন্য চার দেওয়ালের আবদ্ধেই রকমারি মননশীল আনন্দ প্রদানের আয়োজন রাখলে বেশ ভালো হয়। তাদের পড়াশুনার বাইরে অন্যান্য কাজেও প্রতিনিয়ত উৎসাহ দিতে হবে। শিশুদের প্রতি যত্ন ,ভালোবাসা, স্নেহ, মায়া মমতার ডালা বাড়িয়ে দিতে হবে বড়দেরই। শিশুমন জাগরণে, বিকাশে, উচ্ছ্বাস, অনাবিল উদ্দীপনায় ভরিয়ে দিতে বাবা-মা, বড়দের পাশাপাশি প্রত্যেকের গঠনমূলক ভূমিকা পালন করতে হবে।
ইনডোর গেমস, পড়াশুনায় উৎসাহের নিরন্তর উৎসাহ প্রদান করা ছাড়াও তাদের মনের মতন বই, গল্পের বই পড়তে দিতে হবে, যাতে আনন্দ পায় তা পড়তে দিতে হবে এবং অবিরাম বই পড়ার মতো সু অভ্যাস জারি রাখতে হবে। মা-বাবার সাথে এক সঙ্গে গান গাওয়া, ছবি আঁকার মতো কাজগুলো করতে হবে এখানে তাদের বাবা মায়ের প্রতি ভালোবাসা স্নেহ মায়া মমতা সুন্দরভাবে প্রতিফলিত ও বিকশিত হয়। বাবা-মায়ের সঙ্গে তাদের চিরন্তন বন্ধনটা আরো আত্মিক বন্ধুত্ব প্রবণ হয়ে ওঠে। এ সময় তাদের সাথে বাবা-মাকে বেশি সময় কাটাতে হবে, শিশুদের আবেগ ও অনুভূতি বোঝার চেষ্টা করতে হবে মননশীল, সহানুভূতি প্রবণ আবেগের দৃষ্টিভঙ্গিতে। শিশুদের বারান্দায়, ছাদে নিয়ে হাঁটতে পারেন মা-বাবারা। এছাড়া ছাদ বাগান তৈরিতে তাদের উৎসাহ অনুপ্রেরণা দেওয়া যেতে পারে ।রাত্রিবেলায় শিশুদের রাতের আকাশ দেখিয়ে তাদের সুপ্ত মনোযোগ বাহারি অনুভূতিতে রাঙিয়ে দিতে পারেন।। শিশুদের জন্য এসময়টার উপযোগি বিকল্প আনন্দের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। তারা কখনো যেন নিজেদের জগত থেকে বিচ্যুত না হয়ে যায়।
এই কঠিন সঙ্কটের সময় অভিভাবক, অভিভাবিকাদের সর্বদা ধীর স্থির মাথা ঠান্ডা রেখে শা পরিস্থিতিকে মুকাবিলা নিয়ন্ত্রণ হবে। সরল সাদা মনের শিশুদের বলে বোঝাতে হবে কী কারণে তারা বাড়ির গন্ডির চার দেওয়ালের পরিবেশের মধ্যে আটকে আছে? সমস্ত শিশুদের পরিস্থিতি সাপেক্ষে মহামারীর সংক্রমণ, প্রাদুর্ভাব বিধি নিষেধ সম্পর্কে সতর্কতার বাস্তবতাটা বোঝাতে হবে। তাকে একটি রোজনামচা করে দিতে হবে, যেটাকে সে তার প্রাত্যহিক জীবনে মেনে চলার চেষ্টা করবে। সেই রুটিনমাফিক জীবনে অবশ্যই বৈচিত্র্যের সম্ভার, শৃঙ্খলা, নিয়মাবলী, বিধি নিষেধ থাকতে হবে। বাড়ির চার দেওয়ালের মধ্যেই যদি আমরা একটা নিদৃষ্ট জায়গা বেছে দেই তাদের জন্য, যে এটা তোমাদীর বাড়ির বিদ্যালয়, এটা তোমাদের খেলার জায়গা এই সময়টাতে তোমারা এই কাজটা করবে- এগুলো শিশুকে সহজ সরল সুন্দরভাবে শিখিয়ে বুঝিয়ে দিতে হবে। কোন অবস্থাতেই নিষ্পাপ ফুলের মত শিশুদের ওপর কোনো কাজ পড়াশোনা জোর করে চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। তারা যদি খেলতে চায়, গান গাইতে চায়, টিভি দেখতে চায়, ছবি আঁকতে চায়, গল্পের বই পড়তে চায় সেগুলো রুটিনের মধ্যে এনে দিতে হবে। শুধুমাত্র তাকে নির্দেশ মতো করলেই হবে না, মা-বাবাকেও প্রতিনিয়ত তাদের মনের সঙ্গে মিশে গিয়ে ভালোবেসে স্নেহ আদর দিলে যথাযথ সঙ্গ দিয়ে সময় কাটাতে হবে। তার বন্ধুদের সঙ্গে মাঝে মাঝে ফোনে ভিডিও কলে কথা বলা যেতে পারে। এক্ষেত্রে তাদের বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে মনের ঘনীভূত একঘেয়েমি অনেকটাই দূর হয়ে যায়। সবশেষে শিশুদের সৃজনশীলতা বাড়িয়ে আনন্দময় পরিবেশ তৈরির ওপর জোর দেওয়া এ সময়ে খুবই জরুরী । কোভিড অতিমারির সংকটের সময় বাবা মাকে আরো বেশি অনুভূতিপ্রবণ, সংবেদনশীল, স্নেহপরায়ণ , সহমর্মী সর্বোপরি পিতৃত্ব ও মাতৃত্বে পরিপূর্ণ জারিত হয়ে শিশুদের প্রতি আরো যত্নশীল হতে হবে। এই মুহূর্তে দেশ তথা জাতির ভাবি প্রজন্ম ও কান্ডারী দের প্রতিপালনে বাবা-মায়েদের এই দায়িত্বটুকু অবশ্যই পালন করতে হবে।
-পাভেল আমান-শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক-মুর্শিদাবাদ-পশ্চিমবঙ্গ
Leave a Reply