শনিবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৮:২৪ অপরাহ্ন

আত্মহত্যা নাকি হত্যাকাণ্ড: বিভুরঞ্জন সরকারের মৃত্যু প্রসঙ্গে

আত্মহত্যা নাকি হত্যাকাণ্ড: বিভুরঞ্জন সরকারের মৃত্যু প্রসঙ্গে

হাসনাইন সাজ্জাদী।।

আমার দেখা বিভুরঞ্জন দা

চলতিপত্র নামে একটি কাগজ বেরুবে। বন্ধু তুষার আব্দুল্লাহ আমাকে পথ থেকে ধরে নিয়ে গেলেন চলতিপত্রের অফিসে। প্রথমেই দেখা মিললো মাহবুব কামাল ভাইয়ের। তাঁর সঙ্গে তুষার আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমাকে কাজের সুযোগ দিতে কামাল ভাইকে অনুরোধ করলেন। কামাল ভাই আমাকে বললেন,- আমরা একটু ব্যাতিক্রম করতে চাই। কী লিখতে চান আপনি বলুন।’ আমি বললাম-টমি মিয়াকে নিয়ে লেখি? তিনি জানতে চাইলেন,টমি মিয়ার সাকসেস কী? আমি সংক্ষেপে টমি মিয়ার কর্মকাণ্ডের কথা বলতেই তিনি সম্মতি দিলেন। লিখলাম ম্যাগাজিনের ১ পৃষ্ঠার অনুপাতে। ছাপা হলো অর্ধেক পৃষ্ঠায় “সাফল্যের রাজপুত্র টমি মিয়া” নামে। কয়েক সংখ্যায় এভাবে এটা ওটা লিখতে থাকি। অর্ধেক পৃষ্ঠা করে ছাপা হয়।

নিকট দূরে একটি টেবিলে বিভুদা বসে প্রবন্ধ পড়েন মন দিয়ে। সম্পাদনা করেন ঝুঁকে বসে। আসার সময় তাঁকে নমস্কার জানিয়ে আসি। একদিন ডেকে বলেন-‘জায়গা কম।অর্ধেক পাতা দিচ্ছি। অসুবিধা হচ্ছে না তো আপনার?’ বুঝালাম কত বড় মাপের মানুষ। এখন জানলাম তার অভিমানটাও ছিল তাঁর উচ্চতা বরাবর।

অভিমানে দাদা আত্মহত্যা করলেন

‘সকল আত্মহত্যা আত্মহত্যা নয়
কোনো কোনো আত্মহত্যা -হত্যাকাণ্ডের সমান
তিলে তিলে ঠেলে দেয় যাকে
সমাজ ও রাষ্ট্র
মৃত্যুর দিকে
তার আত্মহত্যা হত্যাকাণ্ডেরই সমান।
বিভুরঞ্জন সরকার সাংবাদিক
তার আত্মহত্যা এমনই এক হত্যাকাণ্ড…’

আত্মহত্যা শব্দটি শুনলেই আমাদের মনে ভেসে ওঠে এক গভীর মানসিক যন্ত্রণা, অসহায়ত্ব আর হতাশার ছবি। কিন্তু সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে দেখা যায়, সকল আত্মহত্যাই নিছক ব্যক্তিগত দুর্বলতার ফল নয়। অনেক আত্মহত্যা আসলে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর নির্মম চাপ, বৈষম্য, প্রাতিষ্ঠানিক অনাচার এবং মানসিক নির্যাতনের ফসল। তাই একেকটি আত্মহত্যাকে হত্যাকাণ্ড হিসেবেও ব্যাখ্যা করা যায়।

আত্মহত্যা ও হত্যার সীমারেখা

কোনো মানুষ স্বেচ্ছায় নিজের জীবন নিলেও যদি তার পেছনে থাকে দীর্ঘদিনের সামাজিক বঞ্চনা, রাষ্ট্রীয় অবহেলা, পেশাগত অবমূল্যায়ন কিংবা অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ালে নিপীড়ন—তাহলে সেটি নিছক আত্মহত্যা নয়। তাকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হয়, যেমন করে ফাঁসির মঞ্চে একজন আসামিকে ঠেলে নিয়ে যাওয়া হয়। এই প্রক্রিয়াটিই আত্মহত্যাকে পরিণত করে হত্যাকাণ্ডে।

বিভুরঞ্জন সরকার: এক সাংবাদিকের বেদনার গল্প

বিভুরঞ্জন সরকার ছিলেন এক সময়ের নিবেদিতপ্রাণ সাংবাদিক। তিনি কণ্ঠস্বর দিয়েছেন সাধারণ মানুষের কথা, তুলে ধরেছেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। কিন্তু এই সমাজ ও রাষ্ট্র তার পেশাগত মূল্যায়ন দেয়নি, বরং নানা অবহেলা, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, মানসিক চাপ আর একাকিত্বের মধ্যে তাকে ফেলে রেখেছে। যে রাষ্ট্র সাংবাদিককে তার প্রাপ্য সম্মান, নিরাপত্তা এবং জীবিকা দিতে ব্যর্থ হয়, সেই রাষ্ট্রই তাকে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়।

তার মৃত্যু তাই নিছক ব্যক্তিগত ব্যর্থতার ফল নয়; এটি রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি। সমাজ ও রাষ্ট্র যদি দায়িত্ব পালন করত, সাংবাদিকদের পেশাগত নিরাপত্তা, ন্যায্য মজুরি, মানসিক স্বাস্থ্যের সহায়তা এবং সম্মান নিশ্চিত করত, তবে হয়তো বিভুরঞ্জন সরকার আজ বেঁচে থাকতেন।

সামাজিক দায় ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব

বিভুরঞ্জনের মৃত্যু আমাদের সামনে প্রশ্ন তোলে—আমরা কি সাংবাদিকদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করতে পেরেছি? সমাজ কি তাদের সম্মান দিতে শিখেছে? রাষ্ট্র কি তাদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করেছে? উত্তরটি দুঃখজনকভাবে ‘না’।

সাংবাদিকরা প্রান্তিক মানুষের কণ্ঠস্বর তুলে ধরলেও নিজেরাই প্রায়শই প্রান্তিক হয়ে পড়েন। অনিয়মিত বেতন, রাজনৈতিক চাপ, আইনি হয়রানি, জীবননাশের হুমকি—সব মিলিয়ে তারা এমন এক মানসিক যন্ত্রণা বহন করেন, যা অনেক সময় মৃত্যুর পথ বেছে নিতে বাধ্য করে। এ অবস্থায় তাদের আত্মহত্যা আসলে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় হত্যার শামিল।

উপসংহার
দাদা আত্মহত্যা করেছেন। মেঘনা নদীতে তাঁর লাশ পাওয়া গেছে। শেষ লেখাটি তার আমরা পড়েছি। সে লেখাতেই তিনি জীবন যুদ্ধের ব্যর্থতার কথা লিখে গেছেন। অনেক কথাই সে লেখায় উঠে এসেছে। সবই আমাদের সমাজ ব্যবস্থার অন্ধকার দিক। আলোকিত হয়েছেন তিনি এসব বলতে পেরে।

বিভুরঞ্জন সরকারের মৃত্যু আমাদের চোখ খুলে দেওয়ার মতো এক নির্মম সত্য। তিনি আত্মহত্যা করেছেন, কিন্তু সেই আত্মহত্যা আসলে রাষ্ট্র ও সমাজের হাতেই সংঘটিত হত্যাকাণ্ড। আমাদের দায়িত্ব হলো এমন পরিবেশ তৈরি করা, যেখানে কোনো সাংবাদিক বা সাধারণ মানুষকে আর বঞ্চনা, নিপীড়ন বা হতাশার কারণে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হবে না।

আত্মহত্যা রোধ করতে হলে শুধু ব্যক্তিগত মানসিক স্বাস্থ্য নয়, রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক কাঠামোতেও ন্যায়বিচার, সমতা ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। না হলে প্রতিটি বিভুরঞ্জন সরকারের মৃত্যু আমাদের জন্য এক নীরব হত্যার দায় হয়ে থাকবে।

এই সংবাদটি শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




raytahost-demo
© All rights reserved © 2019
ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: Jp Host BD