শান্তশ্রী
ক্রিপুরা, ভারত
শিবালিক পাহাড়ের কোলে গঙ্গার তীরে হৃষিকেশ। পতিত উদ্ধারিনী সুধাবাহী মা গঙ্গা কে বুকে ধারণ করে আছে হৃষিকেশ। গাড়োয়াল হিমালয়ের একেবারে পায়ের তলায় প্রাচীন পবিত্র তীর্থভূমি হৃষিকেশ।
—-
মনে মনে আশা ছিলো, কল্পনায় এঁকেছিলাম তার ছবি। আমার ভাগ্য আমায় নিয়ে গেলো হৃষিকেশে। ধন্য হোল আমার চর্ম চক্ষু।
—-
হৃষিকেশকে বলা হয় স্বর্গের তোরণ। পুরাণে পড়েছি ভগবান বিষ্ণু মধুকৈটভ নামক রাক্ষস দের এখানেই বধ করেছিলেন।
—-
কেদার, বদ্রী, যমুনোত্রী, গঙ্গোত্রী –এই চার নামের যাত্রা শুরু হয় এখান থেকেই।
—
প্রাচীন যুগে মুনি ঋষিদের তপস্যা ক্ষেত্র ছিলো এই ঋষিকেশ। তপোবনের মতো সুন্দর, স্নিগ্ধ পরিবেশ মনকে উদাস করে দেয়। মনকে নিয়ে যায় কোনো এক কল্প লোকে।
—মহাভারতের যুগ থেকেই হৃষিকেশ প্রসিদ্ধ। এর প্রাকৃতিক অসাধারণ সৌন্দর্য আর কিশোরী গঙ্গার স্বর্গীয় সৌন্দর্যে অবগাহন করার জন্য যুগে যুগে কতো সহস্র মুনি ঋষি, সাধু সন্ত, ভ্রমণবিলাসীরা ছুটে এসেছেন। তাদের পবিত্র পদধূলি তে ধন্য হয়েছে হৃষিকেশের মাটি। ঋষি যোগীরা এখানে এসেছেন তপস্যা করতে, মোক্ষ লাভের অমোঘ আশায়। কেউ পেয়েছেন মুক্তির পথ, কেউবা হয়েছেন নিরাশ।
—–
হৃষিকেশের মাটি ধন্য হয়েছে মহাভারতের কুন্তি, গান্ধারী, বিদুরের পদস্পর্শে। পঞ্চপাণ্ডব কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের শেষে স্বর্গারোহণ করেছিলেন এই পথে।
—
কি করে হৃষিকেশ নাম হোল? -এ নিয়ে নানা মুনির নানা মত রয়েছে।
—কথিত আছে রায়াভ্যা নামে এক ঋষি এখানে তপস্যা করেছিলেন তার তপস্যায় তুষ্ট হয়ে হৃষিকেশ অর্থাত্ মহাদেব তাকে দর্শন দেন। তাই এই স্থানের নাম হৃষিকেশ।
—-আরেকটি কাহিনী রয়েছে —
অনেক দিন আগে এখানে ই ছিলো রৈভ্য ঋষির আশ্রম। এই রৈভ্য ঋষি ছিলেন ভরদ্বাজ মুনির অন্তরঙ্গ বন্ধু। একদিন ভরদ্বাজ মুনি তার পুত্র যবক্রীতকে নিয়ে রৈভ্যঋষির আশ্রমে আসেন। ঋষি পত্নী কে দেখে যবক্রীতের মনে প্রেম জাগ্রত হয়। তিনি সুন্দরী ঋষি পত্নীকে কামনা করলেন।
রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে রৈভ্যঋষি নিজের কেশ ছিড়ে আগুনে আহুতি দেন। সেই আগুন থেকে উঠে আসে এক ভয়ংকর রাক্ষস। সে যবক্রীতকে বধ করে।
—রৈভ্য ঋষি নিজের কেশ ছিঁড়ে আগুনে আহুতি দিয়েছিলেন বলে এই স্থানের নাম হয় হৃষিকেশ।
—
কথিত আছে ভাতৃভক্ত ভরত এখানে তপস্যা করেছিলেন। এখানে ভরতের ও একটি মন্দির রয়েছে।
—
হৃষিকেশেই রয়েছে লক্ষ্মণ মন্দির। বহু প্রাচীন মন্দির। কোন বাহুল্য নেই। মন্দির দর্শন করলেই মন চলে যায় বহু বহু যুগ পেছনে। মন্দিরে রাম লক্ষ্মনের মূর্তি। শি বালিক পাহাড়ের কোলে লক্ষ্মণ মন্দির মনে গেঁথে রইলো। কথিত আছে রাবণ বধের পর ব্রহ্ম হত্যার পাপ থেকে মুক্তি পেতে লক্ষ্মণ এখানে তপস্যা করেছিলেন। রাবণ ছিলেন ব্রাহ্মণ। গঙ্গা পার হওয়ার জন্য লক্ষ্মণ দড়ি দিয়ে পুল তৈরী করেছিলেন। ঝুলে ঝুলে তিনি অন্য পাড়ের পাহাড়ে যেতেন। তাই ঝুলন্ত পুলাটির নাম লক্ষ্মণ ঝুলা। ১৯২৯সালে রাজা এই পুলটি লোহার তার আরও সিমেন্ট দিয়ে তৈরী করেন। তবে আজো পিলার ছাড়াই ঝুলে আছে পুলটি। শতশত লোক যাতায়াত করছে। বাইক যাচ্ছে এই ঝুলন্ত সরু দড়ির পুল দিয়ে। পুলটি দুলছে দোলনার মতো।
—-
শি বালিক পাহাড়কে সঙ্গী করে মা গঙ্গা আবির্ভূতা হোন হৃষিকেশে। শি বালিক পাহাড়টিও হিমালয়ের রেঞ্জের মধ্যে পড়ে। এতো সুন্দর পাহাড়, অপূর্ব। আমি পাহাড়ী রাজ্যের মেয়ে, তবু শিবালিকের সৌন্দর্য মনোমুগ্ধকর।
—শিবালিকের গায়ে রয়েছে সুপ্রাচীন শিব মন্দির। ভারতবর্ষের সবচাইতে উঁচু শিবলিঙ্গ এখানে পূজিত হয়। বিশাল বড় কালো পাথরের শিবলিঙ্গ। ছবি তোলা নিষেধ।
—হৃষিকেশের মধ্যদিয়ে বয়ে চলেছে কিশোরী গঙ্গা –কলকল, ছলছল, স্বচ্ছ সলিলা। কি তার রূপ! আহা! আমার জীবন ধন্য, চোখ ধন্য। আবারও যেন আসার সৌভাগ্য হয় এই নয়নাভিরাম গঙ্গার তীরে।
—
গঙ্গোত্রী থেকে হৃষিকেশ হয়ে হরিদ্বার –এখান দিয়েই গঙ্গার সমতলে প্রবেশ… যুগযুগান্তর ধরে হৃষিকেশের সৌন্দর্যে পাগল হয়ে এসেছেন তীর্থযাত্রী, এসেছেন ভ্রমণবিলাসীরা।
—
হৃষিকেশ আমায় স্বপ্নে ডাকে –আমি ঘুরে বেড়াই শিবালিকের কোলে গঙ্গার পাড়ে…..
Leave a Reply