ভ্রমণ কাহিণী, ১
সোনিয়া তাসনিম খান
পেশায় একজন লেখিকা হলেও ভ্রমণ আমার নেশা বা শখ। তাকে যাই বলি না কেন, এর প্রতি আমার আকর্ষণ দুর্নিবার। প্রায়ই বাচ্চাদের স্কুল ছুটির অবকাশে এখানে ওখানে যাওয়া হয় আমাদের। কখনও বা আমার জন্মভূমির মায়ার টানে আবার কখনও বা দেশের বাইরে বিভিন্ন প্রান্তে। ভ্রমণ বিষয়ে আমার নিজস্ব একটা অভিমত আছে, কিংবা বলা যায় আমার motto অফ ট্রাভেলিং সৃষ্টিকর্তা তাঁর সৃষ্টিকে বড় অপরুপ ভাবে সৃষ্টি করেছেন এর মাধ্যমে তিনি হয়তো তাঁর জান্নাতী সৌন্দর্যের সিকি ভাগেরও কম সৌন্দর্য আমাদের সামনে উন্মুক্ত করে দিয়ে আমাদের ভাবনার দ্বারকে প্রসারিত করার একটা সুযোগ করে দিয়েছেন।ভোরের সূর্য যখন তার কিরণ ছটা আকাশে ময়ুরের রং বেরং এর পেখম এর মত ছড়িয়ে যায় গোধূলি লগ্নে যেমন কনে দেখানোর মায়াবী আলোয় উদ্ভাসিত হয় কিংবা দূর সমুদ্র বুকে অস্তগামী লাল সূর্য টা দিনশেষে তার রাজকীয় বিদায়টা নিতে যায়। এসব দেখে আপনাআপনি মনে চলে আসে পৃথিবীটা কত সুন্দর। এই সুন্দর পৃথিবীর কত জিনিষ না দেখেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হবে! আহা! কেন যে জীবনটা এত ক্ষুদ্র! তাই আমি বলি যত পার ঘুর, দেখ আর জান।জীবনটাকে উপভোগ কর। যা হোক অনেক কথা বলে ফেল্লাম। মোটামুটি ঘুরাঘুরি করা হয় ভালই আলহামদুলিল্লাহ। তবে একজন জাহাজীর সহধর্মিনী হবার সুবাদে আমার ভ্রমণ experience এর ভান্ডারে যে রোমান্চকর থ্রিলিং, ফিলিং যাই বলি না কেন যেটা আছে তা বোধকরি সবার পক্ষে অনুভব করা সম্ভব নয় যে এটা অবশ্য সহজেই অনুমেয়। আমার এই ছোট ভ্রমণ অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে এই অনুভূতিগুলোই শেয়ার করতে চাই। এটা আমার কাছে অনেকদিক দিয়েই খুব গুরুত্বপূর্ণ যেহেতু এটা আমার বিয়ের পর প্রথম দেশের বাইরে কোথাও পা ফেলা, বলা যায় হানিমুন ট্রিপ, ঐবারই আমি জীবনে প্রথম ফ্লাই করি, এবং আমার দেশে থেকে আমার স্বামীর কাছে জাহাজে যাওয়া পর্যন্ত আমি একা ট্রাভেল করেছি। যেখানে এই আমি ইউনিভার্সিটি লাইফ পর্যন্ত কখনও একা একা মোহাম্মদপুর থেকে ধানমন্ডি অবধি যাতায়ত করি নি। তাই এই ট্যুরটা আমার জন্য ছিল এক্সাইটিং+থ্রিলিং অ্যাজ ওয়েল অ্যাজ চ্যালেন্জিং অলসো। তাহলে বলছি আমার সমুদ্রঅভিযানের কথা। আমার সমুদ্র বিলাস।
সালটা ২০০৭। জুলাই মাসের ৭ তারিখ। আমি গুলশান ১ এ নেদারল্যান্ড অ্যাম্বেসীর সামনে ওয়েট করছি আমার পাসপোর্টের জন্য। গত সাতদিন আগে সেনজেন ভিসার জন্য ইন্টারভিউ ফেস করেছিলাম, বাপরে 🙉! কি ইন্টারভিউ। মোটামত এক সাদা চামড়ার ডিউটি অফিসারের কাছে প্রশ্নবাণে জর্জরিত হচ্ছিলাম। আমার নতুন পাসপোর্ট তার উপর প্রথম দাঁড়িয়েছি সেনজেন ভিসার জন্য। এই সেই প্রশ্ন, নানা ডকুমেন্টস চেক এর পর পাসপোর্ট টা জমা রেখে সাতদিন পর আসতে বলল। বাইরে এসে দেখলাম কর্তা বেচারা টেনশানে কাত। আমারও কম হচ্ছিল না। এত নার্ভাস আমরা মনে হয় প্রেম করে ধরা পড়ার সময়েও ছিলাম না। যা হোক, শুকনো মুখে বাদাম চিবুতে চিবুতে বাসায় আসলাম। এর মাঝে ও আবার ৫ তারিখে জয়েন করল জাহাজে। এবার প্যারা বুঝ! আমি বেচারী একলা রয়ে গেলাম যদি ভিসা পাই তব দেখা হবে প্রিয় বা ওপারে তুমি শ্যাম এপারে আমি অবস্থাটা দাড়ালো এরকম। সে যাক গে, ৭ তারিখ বেলা ১২:০০টায় আবার পাংশুমুখে দাড়িয়ে আছি অ্যাম্বেসীতে মায়ের সাথে। কতক্ষণ পরে ডাক পড়ল। কল রুম থেকে প্যাসেজ পেরিয়ে ইন্টারভিউ রুমে ঢুকলাম। দাঁড়ালাম সেই কাঁচের ওয়ালের সামনে বিপরীত দিক থেকে একজন ডিউটি অফিসারকে আসতে দেখলাম।
:হাই। গুড আফটারনুন। মিস ইউ হ্যাভ গট ইউর ভিসা। বাট ইউ হ্যাভ টু কাম হিয়ার উইথ ইউর পাসপোর্ট অ্যাট নভেম্বর ইন দিস ইয়ার। ওকে! থ্যাংক য়্যু
:থ্যাংক য়্যু ম্যাম।
আমি একটা জিনিষ লক্ষ্য করলাম এতক্ষণ এই রুমটাকে বেজায় বদ্ধ মনে হচ্ছিল। কিন্তু এখন এত প্রাণবন্ত লাগছে কেন? এক প্রকার দৌড়ে বাইরে আসলাম। মা বেচারী আয়তুল কুরসী পড়তে পড়তে শেষ। কেন যেন মনে হলো আজ আমার কোন বোর্ড পরীক্ষার ফল বেরুবে। মায়ের দিকে এগিয়ে শুকনা মুখে বললাম
:মা, ভিসা হয়েছে। ক্ষিদে লেগেছে। চাইনিজ খাব।
মা আমার এগাল থেকে ওগাল পর্যন্ত হাসি দিল। আমার একহাতে তখন আমার পাসপোর্ট। তাতে আমার জ্বলজ্বলে ভিসা। আমার সোনার হরিণ। আহা কি শান্তি! রবি ঠাকুর হিসেবে নিজেকে আবিষ্কার করলাম। মনে মনে গুন গুনালাম:
“আমি পাইলাম, উহাকে পাইলাম,অবশেষে আমি উহাকে পাইলাম”
(চলবে
Leave a Reply