ফাইল ছবি
নিউজ ডেস্কঃ
তিনটি মেগা প্রকল্পের কাজ শেষ হলে বদলে যেতে পারে দেশের অর্থনীতির চিত্র। সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণে অবদান রাখতে পারে এ প্রকল্পগুলো। প্রকল্পগুলো হচ্ছে—পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল এবং কর্ণফুলী টানেল। এগুলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অগ্রাধিকার প্রকল্পের আওতাভুক্ত।
পদ্মা সেতু চালু হলে তা দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রায় আমূল পরিবর্তন আনতে ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। আর কর্ণফুলী টানেল চালু হলে চিত্র বদলে যাবে চট্টগ্রামের। এছাড়া রাজধানীতে দ্রুত যাতায়াতে বড় ভূমিকা রাখবে মেট্রোরেল। নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, দ্রুত ও কম সময়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে খুবই সহায়ক হবে মেট্রোরেল।
পদ্মা সেতু ও মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজ আগামী বছর শেষ হতে পারে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে পদ্মা সেতু ও মেট্রোরেল চালু করার লক্ষ্যে তৎপর সরকার। আর কর্ণফুলী টানেল চালু হবে ২০২২ সালে। তিনটি প্রকল্পে কাজের অগ্রগতি ৬০ থেকে ৯০ শতাংশের কাছাকাছি। প্রাপ্ত তথ্যমতে, গত ১০ ডিসেম্বর পদ্মা সেতুর শেষ স্প্যানটি বসানো হয়েছে। কর্ণফুলী টানেলের দ্বিতীয় টিউবের কাজ শুরু হয়েছে গত ১২ ডিসেম্বর। এ ছাড়া আগারগাঁও থেকে উত্তরা পর্যন্ত মেট্রোরেল আগামী বছর চালু করতে কাজ চলছে পুরোদমে।
অর্থনীতিবিদ ড. জায়েদ বখত বলেন, পদ্মা সেতু বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে বিশাল ভূমিকা রাখতে যাচ্ছে। এই সেতু ঘিরে অনেক অবকাঠামোগত উন্নয়ন হবে। পণ্য পরিবহন সহজ হওয়ায় অনেকে ওই এলাকায় গিয়ে বিনিয়োগ করবেন। দক্ষিণাঞ্চলের উন্নয়নে এটা ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। পাশাপাশি মানুষের ও পণ্যের যাতায়াতে সময় বাঁচিয়ে দেবে।
পদ্মা সেতু নির্মাণ সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। এ বছরে সেই চ্যালেঞ্জ উতরে সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছে সেতুর দুই প্রান্ত যুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে। সেতুর বেশকিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এ সেতুতে গাড়ির লেন থাকবে একেক পাশে দুটি করে এবং একটি ব্রেকডাউন লেন থাকবে।
পদ্মা সেতুর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি জানিয়েছে, এ সেতু যান চলাচলের উপযোগী হতে ২০২২ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত লেগে যাবে। তবে বাংলাদেশের সরকার চেষ্টা করছে, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী বছরের মধ্যেই পদ্মা সেতু উদ্বোধন করার। অর্থাৎ সরকার ২০২১ সালের মধ্যে পদ্মা সেতুর কাজ সম্পন্ন করে যান চলাচল শুরু করতে চায়। বাংলাদেশের সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সম্প্রতি সাংবাদিকদের বলেছেন, এক বছরের মধ্যেই সেতুটি চালু হবে। পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হতে ১০ মাস থেকে এক বছর লাগবে।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘সেতুর কাজ শেষ হতে ২০২২ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত লেগে যাবে বলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে আমাদের জানানো হয়েছে। তবে আমরা তাদের সঙ্গে আলোচনা করছি যাতে এই সময় এগিয়ে নিয়ে আসা যায়। আমরা স্বাধীনতার ৫০তম বছর ২০২১ সালের মধ্যেই সেতুটি চালু করতে চাই।’
মেট্রোরেল: আগামী বছর ২৬ মার্চ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দিনে দেশের প্রথম মেট্রোরেল আনুষ্ঠানিকভাবে চালু করার লক্ষ্যে কাজ চলছে। ঢাকার মতিঝিল-শাহবাগ-ফার্মগেট হয়ে পল্লবীর দিকে গেলেই চোখে পড়ে ভূমি থেকে ওপর বরাবর পথ। মূল সড়ক থেকে প্রায় ১৩ মিটার উঁচুতে বসছে রেলপথ। চলছে স্টেশন নির্মাণের কাজ। বিদ্যুৎ-সংযোগের জন্য খুঁটিও বসে গেছে। এগুলো মেট্রোরেলের নির্মাণযজ্ঞের অংশ। এখন পর্যন্ত প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি প্রায় ৫১ শতাংশ।
ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সাবেক জ্যেষ্ঠ সচিব সচিব এম এ এন সিদ্দিক বলেন, ‘২০১৬ সালে হোলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার পর কাজ ছয় মাস পিছিয়েছিল। এবার করোনার প্রভাবটা আরো সুদূরপ্রসারী, শুরু হয়েছে গত ডিসেম্বর থেকে। এখন প্রকল্পের কাজে যুক্ত বিদেশি নাগরিকেরা ধীরে ধীরে আসছেন। তবে শীতে করোনার প্রভাব বাড়তে পারে বলে শোনা যাচ্ছে। এমনটা হলে প্রকল্প নিয়ে দুশ্চিন্তা আরো বাড়বে। তবে নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজ এগিয়ে চলছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত অংশের মোট দৈর্ঘ্য ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। স্টেশন রয়েছে ৯টি। ১১ দশমিক ০৪ কিলোমিটার ভায়াডাক্ট দৃশ্যমান। পাশাপাশি ৯০ মিটার রেললাইন স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়াও ৯টি স্টেশনের উপকাঠামো নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে। প্রতি মাসে আমরা প্রকল্পের সবশেষ অগ্রগতি জানাই।’
এমআরটি লাইন-৬ বাংলাদেশের প্রথম মেট্রোরেল নির্মাণ প্রকল্পের সার্বিক গড় অগ্রগতি ৫৩ দশমিক ৫৮ শতাংশ। প্রথম পর্যায়ে নির্মাণের জন্য নির্ধারিত উত্তরা তৃতীয় পর্ব থেকে আগারগাঁও অংশের কাজের অগ্রগতি ৭৭ দশমিক ৫৭ শতাংশ। দ্বিতীয় পর্যায়ে নির্মাণের জন্য আগারগাঁও থেকে মতিঝিল অংশের কাজের অগ্রগতি ৪৭ দশমিক ৪৯ শতাংশ। ইলেকট্রিক্যাল ও মেকানিক্যাল সিস্টেম এবং রোলিং স্টক (রেলকোচ) ইক্যুপমেন্ট সংগ্রহ কাজের সমন্বিত অগ্রগতি ৪১ দশমিক ৩৯ শতাংশ। আগারগাঁও থেকে কারওয়ানবাজার পর্যন্ত কাজের সার্বিক অগ্রগতি ৫২ দশমিক ১১ শতাংশ। কাওরানবাজার থেকে মতিঝিল অংশের কাজের সার্বিক অগ্রগতি ৫৩ দশমিক ১৫ শতাংশ।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. সামছুল হক বলেন, গণপরিবহনের মধ্যে মেট্রোরেল সবচেয়ে জনগুরুত্বপূর্ণ। যত তাড়াতাড়ি চালু হবে, তত মানুষ উপকৃত হবে। প্রকল্প বাস্তবায়নে যত দেরি হবে, তত ছোট গাড়ি, মোটরসাইকেল বাড়তে থাকবে। এগুলো যানজট বাড়ায়।
কর্ণফুলী টানেলে সাংহাইয়ের মতো হবে চট্টগ্রাম: কর্ণফুলী টানেলের এক প্রান্তে আনোয়ারার ভারী শিল্প এলাকা এবং অন্য প্রান্তে চট্টগ্রাম নগর, বিমানবন্দর ও সমুদ্রবন্দর। বিভক্ত দুই প্রান্তকে যুক্ত করতে কর্ণফুলীর তলদেশে টানেল নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। ৩ দশমিক ৪ কিলোমিটার টানেল নির্মাণ প্রকল্পটি ২০১৫ সালের নভেম্বরে অনুমোদন পায়। বাংলাদেশ সরকার এবং চীনের এক্সিম ব্যাংক যৌথভাবে অর্থায়ন করছে। ব্যয় ধরা হয়েছে ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি ৪২ লাখ টাকা।
২০২২ সালের মধ্যে টানেলটি যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এটি পুরোদমে চালু হলে বছরে প্রায় ৬৩ লাখ গাড়ি চলাচল করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রকল্পটি চালু হলে পাল্টে যাবে চট্টগ্রাম তথা দেশের অর্থনীতি। বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে শিল্পকারখানা ও পর্যটন শিল্পের। কাজের অগ্রগতি ৬১ শতাংশ।
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ভার্চুয়াল মাধ্যমে যুক্ত হয়ে গত ১২ ডিসেম্বর দ্বিতীয় টিউবের কাজ উদ্বোধন করেন। উদ্বোধন শেষে মন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মাণাধীন এ টানেল দক্ষিণ এশিয়ায় নদীর নিচে প্রথম টানেল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল নির্মাণের ফলে চট্টগ্রাম নগর চীনের সাংহাইয়ের মতো ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ মডেল হিসেবে গড়ে উঠবে। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের মধ্যে আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে ওঠার পাশাপাশি এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে সংযোগ স্থাপিত হবে। তিনি আরো বলেন, টানেল নির্মাণকাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। এই টিউব নির্মাণকাজ শেষে ২০২২ সালে টানেলটি যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করার পরিকল্পনা আছে।
কর্ণফুলী টানেলের প্রকল্প পরিচালক হারুনুর রশিদ চৌধুরী বলেন, কাজের গতি বাড়াতে জনবল ও যন্ত্রপাতি বাড়ানো হয়েছে। দ্রুতগতিতে চলছে কাজ। প্রকল্পের সার্বিক কাজের অগ্রগতি ৬১ শতাংশ।
Leave a Reply