পাভেল আমান
আসমুদ্রহিমাচল ভারতবর্ষে জানুয়ারি মাসে বীর সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দর জন্মদিবস পালন, দেশনায়ক নেতাজির জন্মজয়ন্তীর পরপরই ক্যালেন্ডারে যে দিনটাকে ঘিরে দেশাত্মবোধক আবেগ জাগ্রত হয় প্রত্যেক ভারতীয়র মননে, সেটি হল ২৬ জানুয়ারি। এক বর্ণময়, মননশীল অনুষ্ঠান, সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলিত, সুচারু, দৃষ্টিনন্দন কুচকাওয়াজের মাধ্যমে দেশের সংস্কৃতি, ইতিহাসের ছবি ভেসে আসে আপামর ভারতীয়দের মানসে। নয়াদিল্লি থেকে কলকাতা-প্রজাতন্ত্র দিবস (Republic Day) ঘিরে সেজে ওঠে দেশের সকল প্রান্ত। কিন্তু , এই দিনটার গুরুত্ব কী? এই দিনটির নেপথ্যে কী ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে? কি করে ইতিহাসের পাতা উলটে একটু চোখ বুলানো যাক।
ছিল স্বাধীনতা দিবস, হল প্রজাতন্ত্র দিবস-
এই দিনটিকে জাতীর জনক মহাত্মা গান্ধী নাম দিয়েছিলেন, ‘স্বতন্ত্রতা সংকল্প দিবস’। পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর নেতৃত্বে ১৯২৯ সালের বর্ষশেষে পূর্ণ স্বরাজ আনার শপথের পরই ১৯৩০ সালের ২৬ জানুয়ারিকে স্বাধীনতা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পরে, প্রায় দুশো বছরের ব্রিটিশ শাসনের পরাধীনতা ঘুচিয়ে ভারত যখন ১৫ অগাস্ট স্বাধীনতা অর্জন করল, তখন সে দিনটিই স্বাধীনতা দিবসের মর্যাদা পেয়ে গেল।এরফলে ২৬ জানুয়ারি তারিখের অভিধাও বদলে গেল। স্বাধীনতার প্রায় আড়াই বছর পর তৈরি হল দেশের সংবিধান। ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি কার্যকর করা হল দেশের সংবিধান। সেই সূত্র ধরেই ২৬ জানুয়ারিকে প্রজাতন্ত্র দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হল।
সংবিধান যেদিন সংসদ কক্ষে আনুষ্ঠানিক ভাবে গৃহীত হয়, সেদিন পণ্ডিত নেহরুজী বক্তৃতা রাখেন সকলের সামনে । তার মধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা তিনি সেদিন উল্লেখ করেছিলেন যেমন “সমস্ত বুভুক্ষু মানুষের জন্য খাবার, সবার লজ্জা নিবারণের জন্য কাপড় এবং সমস্ত ভারতীয়কে সমান সুযোগ ও সুবিধা দেওয়া যাতে তারা নিজেদের ক্ষমতা অনুযায়ী নিজেদেরকে উন্নীত করতে পারেন “। স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী নেহরুজী অনেক আশা নিয়ে, মহান আদর্শকে সামনে রেখে উপরিউক্ত বক্তব্য দিয়েছিলেন যাতে সবার উন্নতির মাধ্যমে দেশের উন্নতি হয় এবং ভারতবর্ষ সারা পৃথিবীতে একদম সামনের সারিতে থাকে । আপামর ভারতবাসীও নতুন ভারতবর্ষের এক উজ্জ্বল স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং তা নিয়ে আশায় বুক বেঁধেছিলেন । কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে এটা বলতে হয়তো বাধা নেই যে , সেই উজ্জ্বল স্বপ্নের বেলুন চুপসে গেছে । নেহরুজী বর্ণিত কথাগুলি শুধু পুস্তকেই রয়ে গেছে। বাস্তবে তার প্রয়োগ কোথাও হয় না । আজকের দিনে ধনী সমস্ত সুযোগ ও সুবিধা আদায়ের মাধ্যমে আরও ধনী হয়ে উঠছে। যার কাছে অর্থ নেই তার কাছে ক্ষুদা নিবারণের খাদ্য নেই, লজ্জা নিবারণের কাপড় নেই আর সমান অধিকার সেটা শুধু তার কাছে রূপকথার মতো । মানুষ তার অধিকার আর ন্যায্য দাবির জন্য লড়াই করলেও সব সময় তার জন্য মধুরেণ সমাপয়েৎ অপেক্ষা করে না । আজকের দিনে মানুষ প্রধান বিষয় থেকে নজর সরিয়ে বেশিরভাগ সময়টাই গৌণ বিষয় কে নিয়ে চর্চায় বা তার মধ্যে বাঁচতে ভালোবাসছে । যে মহান উদ্দেশ্য নিয়ে ভারত স্বাধীনতা লাভ করেছিল এবং তার সংবিধান রচিত হয়েছিল, আজকে সেখান থেকে আমরা সহস্র যোজন দূরে । জানিনা কোনোদিন সেই কাঙ্খিত লক্ষ্যে আমরা পৌঁছুতে পারবো কিনা ? এই বিবিধ প্রশ্নমালা প্রতিনিয়ত ভারতীয়দের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে।
প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রে প্রজা অর্থাৎ নাগরিকদের সুরক্ষা, বাক্ স্বাধীনতা, ভাষার অধিকার, নিজস্ব ধর্মাচরণের অধিকার, শিল্প সংসৃকতির স্বাধীনতা, সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা মৌলিক অধিকার রূপে গণ্য৷ এই বিশাল দেশ ভারতবর্ষের যে কোনও নাগরিকের দেশের যে কোনও অংশে বসবাস করবার, কর্ম বা চাকুরী করার, সম্পদ সৃষ্টি করার অধিকার রয়েছে৷ অথচ সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন অন্যায্য কারণে নাগরিকদের এই অধিকারে অনধিকার হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে৷ এক রাজ্যের লোক অন্য রাজ্যে লাভ-জেহাদ বা অন্য কোনও অজুহাতে প্রকাশ্য দিবালোকে খুন হচ্ছে৷ নিজ নিজ ধর্মমত অনুযায়ী ধর্মাচরণও পদে পদে বিঘ্নিত৷ গো রক্ষা ও ধর্মান্ধতার নামে বহু মানুষকে মৃত্যু বরণ করতে হয়েছে৷ এক ধর্মমতের প্রতি অন্ধসমর্থন, তোষণ ও কুসংস্কার জনিত কারণে অপর ধর্মাবলম্বীদের লাঞ্ছিত, নিপীড়িত ও উৎপীড়িত করার চেষ্টা চলছে৷ ধর্মমত জনিত অসহনশীলতা বর্তমানে দেশের কোণে কোণে ভয়ঙ্করভাবে ছড়িয়ে পড়েছে৷ বর্তমান সাম্প্রদায়িক ও জাতীয়তা বাদী বিজেপির শাসনাধীন ভারত বর্ষ এক ঘোর তিমিরে আচ্ছাদিত। স্বাধীন ভারতের সাত দশকের জীবনে প্রতিনিয়ত রাষ্ট্র এবং দেশের সীমারেখা লঙ্ঘনের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে প্রতিনিধিত্বমূলক জনগণের দ্বারা নির্বাচিত গণতন্ত্রের প্রকরণটিকে যে কোন অছিলায় কাজে লাগিয়ে, শাসকরা সবসময় অতীব শক্তিমান হয়ে আসীন হয়েছে সাময়িকভাবে গণতন্ত্রের অন্তর্নিহিত নির্যাসটুকু এক নিমেষে ঝেড়ে ফেলতে কোন দ্বিধাবোধ করেননি। বর্তমান শাসক দল সমস্ত কিছুর ঊর্ধ্বে।ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের মূলে আঘাত করে এক অন্য ধাঁচের ভারত গঠনের তৎপরতা জোরদার হচ্ছে ।যে ভারতে গণতন্ত্রের অর্থ সংখ্যাগুরু বাদ শাসনের অন্য নাম আধিপত্য প্রতিপত এবং নাগরিকের প্রতিশব্দ শাসকদলের বশৎবদ অনুগত। গণতন্ত্রের চিরাচরিত সংজ্ঞা আজ বড় অসহায়, সোনার পাথর বাটি। গণতান্ত্রিক বর্তমান ভারতবর্ষে প্রজাতন্ত্র দিবস কেন শ্রেণী শোষণ, বঞ্চনা, সংখ্যালঘু উৎপীড়ন, ধর্মীয় জিঘাংসা, উগ্র জাতীয়তাবাদ, সাম্প্রদায়িক ঝনঝনানিতে পরিণত হয়েছে যেখানে ভারতের বৈচিত্র্য, বহুত্বের পীঠস্থান, মিলন তীর্থ, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য, কৃষ্টি, সংস্কৃতি ক্রমশ অতল গহবরে ডুবে যাচ্ছে। প্রজাতন্ত্র দিবসে আমরা সমস্ত ভারতীয়রা জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে মননে গ্রহণ করে ঐক্যবদ্ধ হয়ে নিষ্ঠাবান,দায়িত্ববান ভারতীয় হিসেবে শপথ গ্রহণ করে ভারতের চিরায়ত গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে অমলিন রাখা।এটাই হোক আপামর ভারতীয়দের ৭২ তম প্রজাতন্ত্র দিবস পালনের নব অঙ্গীকার।
শিরোনাম: ৭২ প্রজাতন্ত্র দিবস পালনের নব অঙ্গীকার।
পাভেল আমান- হরিহার পাড়া- মুর্শিদাবাদ
Leave a Reply