পাভেল আমান
মানুষের দাবি দাওয়া, চাহিদা, অধিকার পূরণ, সর্বোপরি একটা জাতি রাষ্ট্রকে প্রগতির পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করে একটি রাজনৈতিক দল।পরাধীন ভারতবর্ষে পুণ্যভূমিতে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে কংগ্রেস নামক বৃক্ষের যে চারাগাছটি রোপিত হয়েছিল তা আজ প্রাচীন মহীরুহে পরিণত। গণতন্ত্রের ধ্যান-ধারণা এই শতাব্দীপ্রাচীন রাজনৈতিক দলকে যেমন উদারতার শিক্ষা দিয়েছে, তেমনই মুক্ত আলো-বাতাসের অফুরান যোগানে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছিল দলের সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা আপামর ভারতীয়দের মধ্যে। কিন্তু সেই জনপ্রিয়তা ক্রমশ সঙ্কুচিত হয়ে এসেছে বিবিধ রাজনৈতিক পালাবদলে। দেশব্যাপী সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান ও বিকাশ জাতীয় কংগ্রেসকে ক্রমশ অপ্রাসঙ্গিক করার প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে। ধর্মনিরপেক্ষ যে ভারতের আত্মবিকাশ ঘটিয়েছিল কংগ্রেস তার এই দীর্ঘ পথ-পরিক্রমায়, তা ক্রমেই অপসৃয়মান হয়ে পড়ছে। ‘কংগ্রেসই ভারত, ভারতই কংগ্রেস’- বলে যে আপ্তবাক্য একদা চারিদিকে শোনা যেত, তা একসময় ছিল সকল ভারতবাসীর কাছে গ্রহণযোগ্য দিশা। নানাবিধ ঘটনার সমন্বয়ে অথবা দ্বিজাতিতত্ত্বের বৃহৎ প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করেও কংগ্রেস দেশবাসীর হৃদয়ে তার নিজস্ব আধিপত্য খুঁজে নিতে পেরেছিল। এক্ষেত্রে কংগ্রেসের নীতি আদর্শ ছিল তার একমাত্র মুলধন বা পুঁজি। এবারে আসা যাক জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে।
ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতের সিভিল সার্ভেন্ট স্যার এ্যালান অক্টোভিয়ান হিউমের মুখ্য উদ্যোগে তৈরি হওয়া ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার সূচনালগ্নে সংগঠনের প্রথম সভাপতি বাঙালী উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও সঙ্কীর্ণ প্রাদেশিক মানসিকতা দূরীকরণে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য নির্মাণের পথে অগ্রসর হওয়া ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। এছাড়াও সমস্ত ভারতীয়দের জাতীয়তাবাদের আদর্শ উদ্বুদ্ধ করা ও ছিল অন্যতম উদ্দেশ্য। আজ একশ’ চৌত্রিশ বছর পরেও দেখা যাচ্ছে, এই লক্ষ্যে পৌঁছানো কত জরুরী হয়ে পড়েছে। বোঝা যাচ্ছে, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের মতো একটি জাতীয় সংগঠনে প্রাণসঞ্চার করা। তাকে নতুন যুগের উপযোগী করে, বহুত্ব বৈচিত্রের ঐক্যে গড়ে তোলা কত প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। নানাভাষা, নানাধর্ম, নানা প্রাদেশিক মনোবৃত্তির মধ্যে সেতু বাঁধতে প্রশাসন কখনই পারে না। বিশেষত সাম্প্রদায়িক চেতনা বিকাশের এই সময়ে। পারে জাতীয় কংগ্রেসের মতো একটি সর্বভারতীয় দল। উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুরু করে আজকের রাজনৈতিক কুশীলবরা পর্যন্ত দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়া কংগ্রেস তার সর্বভারতীয় অবস্থানে দাঁড়িয়ে নেই। ধর্মান্ধ, সাম্প্রদায়িক, আঞ্চলিক দলগুলো ক্রমশ কংগ্রেসের ডালপালা ছেঁটে দিচ্ছে। কংগ্রেসও নতুন করে তার ডালপালা আর বিস্তার করতে পারছে না। প্রতিষ্ঠাকালে বলা হয়েছিল, ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে যারা দেশের উন্নতির জন্য কাজ করছেন, তাঁদের মধ্যে পরিচয় ও সৌহার্দ্য স্থাপন করা। এই উপায়ে জাতি, ধর্ম ও প্রাদেশিক মনোবৃত্তির সঙ্কীর্ণতা দূর করে জাতীয় ঐক্যসাধন। দেশের শিক্ষিত ব্যক্তিদের মধ্যে আলোচনার দ্বারা গুরুতর সামাজিক সমস্যার সমাধানের পথ নির্ধারণ করা এবং রাজনৈতিক উন্নতির জন্য পরবর্তী বছরটি কার্য প্রণালী অবলম্বন করা উচিত, সেটা স্থির করা। ১৮৮৫-এর ২৮ ডিসেম্বর মুম্বাইর গোকুলদাস তেজপাল সংস্কৃত কলেজের হলঘরে যে জাতীয় কংগ্রেসের সূত্রপাত, উনিশ শতক থেকে একুশ শতকে এসে তা নানাবিধ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এগিয়েছে। কিন্তু যত পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই যাক আসমুদ্রহিমাচল ভারতবাসীর মনে এই সংগঠনটিই একমাত্র জাতীয় সংগঠন হিসেবে একশ’ বছরের বেশি সময় ধরে তার প্রভাব অক্ষুণ রাখতে পেরেছে। ভারতবাসীর একমাত্র জাতীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে পেরেছিল বিশ শতকে। ভারতে সংসদীয় গণতন্ত্র অব্যাহত রয়েছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ঘেরাটোপে খাবি খাচ্ছে ভারতের সংসদীয় শাসন ব্যবস্থা। বহুত্বের মিলন তীর্থ, বৈচিত্রের ঐক্য ও ঐতিহ্য অনুসারে, নানা ভাষা নানা মতের আজন্ম লালিত সম্প্রীতির ভারত বর্ষ আজ ভেঙ্গে খান খান। সর্বত্রই মাথাচাড়া দিয়েছে উগ্র জাতীয়তাবাদের নামে হিন্দুত্ববাদীদের নিদারুণ লম্ফঝম্পও। ধর্মনিরপেক্ষতার মোড়কে দেশপ্রেমের প্রমাণ দিতে গিয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আজ বিপন্ন দিশেহারা বিপর্যস্ত। প্রতিনিয়ত নিরাপত্তাহীনতায় কুরে কুরে খাচ্ছে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমস্ত জনগণকে ভারতীয় হিসেবে সাম্য, সোভ্রাতৃত্ব, ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদী চেতনায় এক সুরে বাঁধতে গেলে অবশ্যই ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের রাজনৈতিক পরিচয় ছাড়া বিকল্প এই মুহূর্তে নেই।নেতৃত্বের দুর্বলতা থাকা সত্ত্বেও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির ধারায় ভারতকে ফিরে পেতে হলে কংগ্রেসের বিকল্প আর নেই। এই চরম সন্ধিক্ষণে, সঙ্কটকালে ভারতের সংসদীয় রাজনীতি জাতীয় কংগ্রেসের ভূমিকা ও অবদান প্রাসঙ্গিক । আজ ২৮ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠা দিবসে সবিশেষ স্মরণ করি ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সংসদীয় রাজনীতিতে তাৎপর্য ও চিরায়ত গুরুত্ব।
পাভেল আমান- হরিহরপাড়া- মুর্শিদাবাদ-
Leave a Reply