পাভেল আমান
বহু প্রাচীনকাল থেকেই উৎসব মানুষের জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। উৎসব মাত্রেই কোন না কোন ধর্মের সঙ্গে যুক্ত থাকে তবু বলা হয় ধর্ম যার যার উৎসব সকলের। আনন্দের যেমন কোন ধর্ম হয় না, তেমন উৎসব উদযাপনের ও কোন ধর্ম হয় না। বড়দিন এ ক্ষেত্রে অনন্য।এটি বড়দিন হিসেবে পরিচিত হলেও পাশ্চাত্যে এটি ক্রিসমাস নামে পরিচিত।
বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মহামানব যিশুখ্রিস্টের জন্মদিন শুধুমাত্র খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী মানুষদেরই নয়, তামাম বিশ্ববাসীর কাছে এক আনন্দ, উৎসবের মুখরিত দিবস। মানবতার পরিত্রাতা ও সর্বোপরি অহিংসার পূজারী যিশুর জন্মদিনে ক্যারলের সুরে কলগুঞ্জরিত হয়ে ওঠে আলোয় সজ্জিত গির্জা গুলি,সুস্বাদু কেক কুকিজের গন্ধে বেকারির সামনের রাস্তায় গুলি পথচলতি সাধারণ মানুষের মনকে করে তুলে আনমনা, আনন্দিত।
অন্ধকারে আলো জ্বেলেছিলেন। দেখিয়েছিলেন মুক্তির পথ, যে পথে চললে জীবন হয়ে ওঠে শান্তিময়। তিনি যিশুখ্রিস্ট, যাঁকে ক্রুশবিদ্ধ হতে হয়েছিল মানবজাতিকে পাপীর হাত থেকে মুক্ত করার জন্য। পরম ধামে যাওয়ার পথ বাতলে দেওয়া সেই যিশুর জন্মদিন আজ। আজ শুভ বড়দিন বা ক্রিসমাস ডে।এই কথাটি আসলে এসেছে ‘ক্রাইস্টস মাস’ থেকে। মোটামুটিভাবে ষোড়শ শতাব্দী থেকে চালু হয় এই শব্দবন্ধ। খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব।আজকের দিনে খ্রিস্ট ধর্মের প্রবর্তক যিশুখ্রিস্ট বেথেলহেমে জন্ম নিয়েছিলেন। ঈশ্বরের মহিমা প্রচার এবং মানবজাতিকে সত্য ও ন্যায়ের পথে পরিচালিত করতে পৃথিবীতে এসেছিলেন যিশু। আজ তাঁরই জন্মদিনের নতুন উচ্ছ্বাসে, আলোকপ্রভায় দেখা দেবে নতুন দিন। শুদ্ধ মনে শুধুই আলো নেচে উঠবে চারধারে।বড়দিনের উৎসব পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব। আর এ উৎসবের প্রধান একটি অনুষঙ্গ হলো ক্রীসমাস ট্রি। শিশুদের কাছে এ দিনের প্রধান আকর্ষণ শান্তাক্লজ। তিনি শিশুদের জন্য নানা উপহার ও চমক নিয়ে আসেন। এছাড়া রয়েছে প্রভু যিশুর জন্মদিনের কেক। বড়দিন উপলক্ষে সারা পৃথিবী থেকে হাজার হাজার পুণ্যার্থী, যিশুর জন্মস্থান বেথলেহেমে হাজির হন। অনেকে সেখানে মোমবাতি জ্বালিয়ে উৎসব পালন করেন। যিশু যেহেতু বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য ধর্ম ও দর্শন দিয়ে গেছেন, বিশ্বব্যাপী বিশাল অংশের মানুষ তার দেয়া ধর্ম ও দর্শনের অনুসারী। যিনি এতো বড় ধর্ম ও দর্শন দিলেন ২৫শে ডিসেম্বর তার জন্মদিন। সে কারণেই এটিকে বড়দিন হিসেবে বিবেচনা করে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষ।দু’হাজার বছর আগে যিশুর জন্ম হলেও বড়দিন পালন শুরু হয় অনেক পরে। এমনকি যিশুর শিষ্যরাও কখনো তার জন্মোৎসব পালন করেননি বা তাঁর জন্মদিনকে ধর্মীয় উৎসবে রূপান্তর করেননি। এমনকি শুরুর দিকে খ্রিষ্টানদের ধর্মীয় উৎসবের মধ্যে বড়দিন অন্তর্ভুক্ত ছিল না। দ্বিতীয় শতাব্দির দুজন খ্রিষ্টধর্মগুরু ও ইতিহাসবিদ ইরেনাউস ও তার্তুলিয়ান বড়দিনকে খ্রিষ্টানদের উৎসবের তালিকায় যুক্ত করেন।ভারতবর্ষে প্রথম ক্রিসমাস উৎযাপিত হয় ১৬৬৮ সালে। কলকাতা নগরী গোড়াপত্তনকারী জব চার্ণক প্রথম বড়দিন পালন শুরু করেন বলে জানা যায়। ওই বছর হিজলি যাওয়ার পথে সুতানুটি গ্রামে আসার পর চার্ণক খেয়াল করলেন, বড়দিন এল বলে! সেখানেই যাত্রাবিরতি করে বড়দিন পালন করেন চার্ণক। সেই থেকেই আমাদের দেশে বড়দিন পালিত হয়ে আসছে।আজকাল বড়দিন বলতে আমরা যা যা বুঝি সেই সব প্রথার উদ্ভব কিন্তু আরও অনেক পরে।আধুনিক বড়দিনে পালিত বেশির ভাগ রীতি, রেওয়াজ, ঐতিহ্যের শুরু উনিশ শতকের মাঝামাঝি নাগাদ। তার আগে ধর্মীয় উৎসব হিসেবে বড়দিন পালিত হত ঠিকই, কিন্তু সেই সব উৎসবে সাধারণ মানুষের ভূমিকা ছিল নগণ্য। ১৮২০-৩০ নাগাদ সেই ধারার পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে। বড়দিন সেই সময়ের পর থেকে ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে সাধারণ মানুষের পারিবারিক এবং সামাজিক অনুষ্ঠান। বিশ্বের অধিকাংশ দেশে ২৫ ডিসেম্বর বড়দিন পালিত হলেও রাশিয়া, জর্জিয়া, মিসর, আর্মেনিয়া, ইউক্রেন ও সার্বিয়ায় ব্যতিক্রম। জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের জন্য এ দেশগুলোতে ক্রিসমাস পালিত হয় ৭ জানুয়ারি। উত্তর ইউরোপীয়রা যখন খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করে তখন পৌত্তলিকতার প্রভাবে ক্রিসমাস শীতকালীন উৎসবের মতো পালন শুরু হয়। ফলে সেখানকার এ উৎসবে শীত উৎসবের অনুষঙ্গও যুক্ত হয়েছে। এখন পর্যন্ত স্ক্যান্ডিনেভীয়রা এ দিনটিকে `জুন` উৎসব বলে থাকে। সময়ের আবর্তে বড়দিন পেয়েছে সার্বজনীন উৎসবের আবহ। একই সঙ্গে বড়দিন পালনে যুক্ত হয়েছে নানান অনুসঙ্গ। প্রায় দুই হাজার বছর আগে পৃথিবীতে এসে যিশু খ্রিষ্ট মানুষকে দেখিয়েছিলেন মুক্তি ও কল্যাণের পথ। বড়দিনে তাই যিশু খ্রিষ্টকে গভীরভাবে স্মরণ করে সারা বিশ্বের খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বীরা। তারা এ দিনটিকে আনন্দ ও মুক্তির দিন হিসেবে পালন করেন। আজ বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের তান্ডব লীলায় মানবজাতি বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত, মুমূর্ষ ও দিশেহারা। তবুও মানুষ উৎসবকে ভালোবেসেই সমস্ত জরা দুঃখ ব্যথা বেদনা কে ভোলার চেষ্টা করে। শুভ বড়দিনে আপামর সমস্ত মানুষ সংকটের হাত থেকে পরিত্রান লাভ করে যেন ঐক্যবদ্ধভাবে মনোবলকে সাঙ্গ করে উত্তরের দিকে এগিয়ে যাক। ফিরে আসুক মানুষের মধ্যে সেই অনাবিল উচ্ছ্বলতা, হাসিখুশি, অপার মনোভাব। পরিশেষে বড়দিন পালনের মধ্যে দিয়ে আপামর মানুষের মধ্যে কোভিড কের সংক্রমণ মোকাবিলার সমস্ত বিধি নিষেধ, স্বাস্থ্য বিধান যেন আমরা মেনে চলি। সফল প্রতিষেধকের বাস্তবিক প্রয়োগ ছাড়া আমাদের এক্ষেত্রে করণীয় কিছুই নেই। বড়দিনে এটাই হোক আমাদের জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ঈশ্বরের কাছে সমবেত প্রার্থনা ।
পাভেল আমান হরিহার পাড়া- মুর্শিদাবাদ
Leave a Reply