খাদেমুল মোরসালিন শাকীর,নীলফামারী প্রতিনিধি ঃ
নামমাত্র কাজ করে নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার ৫৮ টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নামে বরাদ্দকৃত এক কোটি ১৮ লাখ টাকা লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে। উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা, প্রধান শিক্ষক, তদারকি কর্মকর্তা এবং ম্যানেজিং কমিটির যোগসাজসে এ টাকা লুটপাট করা হয়। কাজ না করে টাকা লুটপাটের কারনে অনেক স্কুলে সহকারী শিক্ষক এবং প্রধান শিক্ষকের মাঝে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে এবং হাতাহাতির ঘটনা পর্যন্ত ঘটেছে।
উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয় সুত্রে জানা গেছে, চতুর্থ প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসুচী (পিইডিপি-৪) এর সাব কম্পোনেন্ট মেইনটেন্যান্স কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রনালয় থেকে ক্ষুদ্র মেরামতের জন্য ৫৪ টি বিদ্যালয়ে ২ লাখ করে এক কোটি ৮ লাখ। দৃর্যোগকালীন মেরামতের জন্য ৪ টি বিদ্যালয়ে ২ লাখ ৫০ হাজার করে ১০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়।
নীতিমালা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও ম্যানেজিং কমিটির উদ্যেগে প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব তহবিল থেকে বরাদ্দের সমপরিমান অর্থ ব্যয় করে আগে কাজ করতে হবে। কাজ শেষ হলে একজন উপজেলা সহকারী প্রকৌশলী ও সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তার তদন্ত সাপেক্ষে প্রত্যয়নপত্র নিতে হবে। সেই প্রত্যয়নপত্র দেখিয়ে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার স্বাক্ষরে বরাদ্দের টাকা উত্তোলন করতে পারবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় বিদ্যালয়গুলোতে নামমাত্র কাজ করে মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে উপজেলা সহকারী প্রকৌশলী এবং সংশ্লিষ্ট ক্লাস্টার অফিসারদের কাছ থেকে প্রত্যয়ন নিয়ে বিল উত্তোলন করে লুটপাট করা হয়েছে।
সরেজমিনে বাহাগিলি ডাংগাপাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে জানা গেছে, ওই বিদ্যালয়ে ক্ষুদ্র মেরামত বাবদ বরাদ্দ দুই লাখ টাকা। আশ্চর্যের বিষয় হল ওই বিদ্যালয়ে গত ২০১০-১১ অর্থ বছরে নতুন একটি ভবন নির্মান করা হয়। এসময় ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রেজাউল ইসলামের কাছে বরাদ্দের অর্থে কি কি কাজ করেছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিদ্যালয়ের ছাদ দিয়ে পানি চুইয়ে পরে বরাদ্দের টাকায় ছাদ ঢালাই দিয়েছি এবং পুরো ভবনটি রং করেছি। নির্মানের কয়েক বছরের মাথায় নতুন ভবনের ছাদ দিয়ে পানি চুইয়ে পড়ল জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভবনটির কাজ নি¤œমানের হয়েছিল।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন প্রধান শিক্ষক জানান, বরাদ্দের ১০ থেকে ১৫ শতাংশ অর্থ উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা ও তদারকি কর্মকর্তাকে দিতে হয় নাহলে তারা প্রত্যয়ন দিতে চায়না। বিল উত্তোলনের পর ম্যানেজিং কমিটির সভাপতিসহ অন্যান্যদের টাকা না দিলে তারা বিভিন্নভাবে টর্চার শুরু করে। সবাইকে ভাগ দিয়ে যা থাকে সে অনুযায়ী হিসাব করে কাজ করতে হয়।
নিতাই ইউনিয়নের গুচ্ছগ্রাম সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায় ওই বিদ্যালয়ে ক্ষুদ্র মেরামত বাবদ দুই লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এসময় দেখা যায়, বিদ্যালয়টির বারান্দার কিছু অংশে গাঁথুনির কাজ করে গোটা বিদ্যালয়টি চুনকাম করে কাজ শেষ করেছেন প্রধান শিক্ষক। ওই বিদ্যালয়ের একজন সহকারী শিক্ষক জানান, গত অর্থবছরে এখানে দুর্যোগকালীন মেরামত বাবদ আড়াই লক্ষ টাকা বরাদ্দ ছিল কিন্তু কাজের কাজ তেমন হয়নি। প্রধান শিক্ষক মশিয়ার রহমান বলেন, আমি বরাদ্দের টাকায় শতভাগ কাজ করেছি। তিনি আরো জানান, কাজ শেষে বিল উত্তোলন করার সময় অফিসে কিছু টাকা খরচ হয় তাই কাজে একটু হেরফের হয়েছে।
মধ্য কালিকাপুর আব্দুল গফুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, বিদ্যালয়টিতে শুধু রংয়ের কাজ করে পুরোটাকা লুটপাট করা হয়েছে। বরাদ্দের টাকার ভাগবাটোয়ারা নিয়ে বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের সাথে প্রধান শিক্ষিকা সামসুন্নাহারের বিরোধ দেখা দিয়েছে। এ বিষয়ে কথা বললে প্রধান শিক্ষিকা সামসুন্নাহার তিনি পুরো বিষয়টি অস্বীকার করেন।
এছাড়াও বাংলাদেশ শিশু সৈনিক সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, পানিয়াল পুকুর দোলাপাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, মুশা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়,মুশা পুষনা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, ভেরভেড়ী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, ভেড়ভেরী কামাল উদ্দিন সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়,পানিয়াল পুকুর খোলাহাটি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, বদি আদর্শ ইউনাইটেড সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়,রণচন্ডি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়,উত্তর দুরাকুটি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়,নিতাই খোলাহাটি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়,কাঠগাড়ী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ অনেক বিদ্যালয়ে গিয়ে একই চিত্র পাওয়া গেছে। তবে ভিন্ন চিত্র দেখা গেছে রণচন্ডি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে। স্কুলের প্রধান শিক্ষক ভরত চন্দ্রের কাছে সংস্কার কাজের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন আমি স্কুলের ঠুটো জগন্নাথ। আমার স্কুলে সরকারী কোন বরাদ্দ আসলে স্কুলের সভাপতি বরাদ্দের টাকা দিয়ে নিজেই কাজ করেন। আমাকে কোন কাজ করতে দেয় না সভাপতি। নিজে কাজ করতে চাইলে সভাপতি আমাকে হুমকি দেয়। বদলীর আদেশ শুরু হলে আমি অন্য স্কুলে চলে যাবো।
এ ব্যাপারে স্কুলের সভাপতি হাবিবুর রহমান হাবুলের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, আমি কি কাজ করেছি সেটা ইঞ্জিনিয়ার ও শিক্ষা অফিস বুঝবে। এখানে সাংবাদিকের কি?
উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শরিফা বেগম বলেন, সরকারী নীতিমালা অনুযায়ী বিদ্যালয় সংস্কার কাজ দেখভাল করার দায়িত্ব সহকারী ক্লাস্টার অফিসার এবং উপজেলা প্রকৌশল দপ্তরের। আমি তাদের প্রত্যয়ন সাপেক্ষে বিল ছাড় দিয়েছি।
উপজেলা প্রকৌশলী মাহমুদুল হাসানের সাথে কথা বললে তিনি বলেন, বিদ্যালয় সংস্কার কাজের দেখভাল করার দায়িত্ব আমার নয়। আমার কাজ ষ্টিমেট করে দেয়া। ষ্টিমেট অনুযায়ী কাজ বুঝে নেয়ার দায়িত্ব উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের। তারপরও আমি দু’একটি বিদ্যালয়ে একজন সহকারী প্রকৌশলীকে পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু ষ্টিমেট অনুযায়ী কাজ না হওয়ায় আমি প্রত্যায়ন দেইনি।
উপজেলা শিক্ষা কমিটির সভাপতি ও উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আবুল কালাম বারী পাইলট বলেন, বিদ্যালয় সংস্কার কাজের অনিয়মের বিষয়ে আমার কাছে অনেক অভিযোগ এসেছে। আমি উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে কাজের মান যাচাই পুর্বক বিল ছাড় দিতে বলেছি।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার নুর-ই আলম সিদ্দিকীর সাথে কথা বললে তিনি বলেন, এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ পেলে আইনঅনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা গ্রহন করা হবে।
Leave a Reply