পাভেল আমান।।
প্রতিটি ধর্মাবলম্বী মানুষের মধ্যেই আপন ধর্ম সম্পর্কে নিষ্ঠা বিশ্বাস শ্রদ্ধা ভক্তি ভালোবাসা অনুভূতি বিরাজমান। মানুষ ধর্মীয় রীতিনীতি, পরম্পরা ঐতিহ্য সংস্কৃতিকে আঁকড়ে ধরেই জীবনে বেঁচে থাকার অবলম্বন খুঁজে পাই। সেখানেই জীবনের ছন্দময়তা পরিপূর্ণতা। এভাবেই ধর্মীয় বিশ্বাসকে লালন পালন করে মানুষের যাপিত জীবন। সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সেরকমই একটি আবহমানকাল ধরে চলে আসা ধর্মীয় উৎসব জন্মাষ্টমী।সারা ভারত বর্ষ জুড়েই শ্রীকৃষ্ণ জন্মাষ্টমীর বিশেষ তাৎপর্য, প্রাসঙ্গিকতা ও জনমানসে চরম প্রভাব, আবেগ, চিরায়ত বিশ্বাস রয়েছে। এটি হিন্দুদের অন্যতম প্রধান উৎসব। এবারে জন্মাষ্টমী পালনের পৌরাণিক ইতিহাসের আলোচনায় আসা যাক। মান্যতা আছে যে, মহাবিশ্বের স্রষ্টা শ্রী হরি বিষ্ণুর অষ্টম অবতার হলেন শ্রী কৃষ্ণ, এই রূপেই তিনি মাতা দেবকীর গর্ভে জন্ম নিয়েছিলেন ।সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মতে দ্বাপর যুগের শেষ দিকে এই মহাপুণ্য তিথিতে মথুরা নগরীতে অত্যাচারী রাজা কংসের কারাগারে বন্দী দেবকী ও বাসুদেবের বেদনাহত ক্রোড়ে জন্ম নিয়েছিলেন পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ।পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অত্যাচারীর বিরুদ্ধে দুর্বলের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং দুষ্টের দমন ও শিষ্টের লালন করতেই এ পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন। শান্তিহীন পৃথিবীতে শান্তি আনতেই শান্তিদাতা শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব।ধর্মাবতার শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন পরোপকারী, প্রেমিক, রাজনীতিক ও সমাজসংস্কারক। সমাজ থেকে অন্যায়-অত্যাচার, নিপীড়ন ও হানাহানি দূর করে মানুষে মানুষে অকৃত্রিম ভালোবাসা ও সম্প্রীতির বন্ধন গড়ে তোলাই ছিল শ্রীকৃষ্ণের মূল দর্শন। দেশের সমস্ত রাজ্যে বিভিন্নভাবে এই মহোৎসব উদযাপন করা হয়।শ্রাবণ বা ভাদ্রমাসের কৃষ্ণপক্ষীয় অষ্টমী তিথিতে সনাতন হিন্দু ধর্মমতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শুভ জন্মদিন। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে দিনটি অত্যন্ত উৎসব-আনন্দ ও শুভময়। হাজার বছর ধরে জন্মাষ্টমীকে সনাতন ধর্মের মানুষ অত্যন্ত উৎসবমুখর ও পবিত্রায় উদযাপন করে থাকেন। শ্রীকৃষ্ণের নাম স্মরণ করে এই দিন আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা ধর্মভীরু হিন্দুরা উপবাস করে থাকেন। এইদিন সমস্ত মন্দির গুলি সাজিয়ে তোলা হয়, চলে ভজন কীর্তন। দিনভর চলে সংকীর্তন, এই দিন স্কুলের ছোট ছোট বাচ্চারা শ্রীকৃষ্ণ সেজে স্কুলে যায়।জন্মাষ্টমীতে শ্রীকৃষ্ণের প্রচুর ভক্তরা সারা দিন-রাত উপবাস পালন করেন, তারপর কৃষ্ণকে পূজা করেন তাঁরা। পুজো করার সময় তাঁরা তার গল্প শোনেন, গীতা থেকে স্তোত্র পাঠ করেন, ভক্তিমূলক গান গেয়ে থাকেন এবং মন্ত্র জপ করেন।কৃষ্ণভক্তদের বিশ্বাস, জন্মাষ্টমী ব্রত পালন করলে সব পাপমোচন ও প্রভূত পুণ্য অর্জিত হয়; এ ব্রত যারা নিয়মিত পালন করে তাদের সন্তান, সৌভাগ্য ও আরোগ্য লাভ হয় এবং পরকালে বৈকুণ্ঠ প্রাপ্তি ঘটে। কোনো কোনো অঞ্চলে এ জন্মাষ্টমী ‘গোকুলাষ্টমী’ নামেও খ্যাত ।সমগ্র ভারতে, এই উৎসবটি খুব আড়ম্বরপূর্ণ ভাবে উদযাপিত হয়। কৃষ্ণের জন্মস্থান মথুরা এবং বৃন্দাবন এই দিনটিকে একটি অতুলনীয় উদ্যোগ এবং জাঁকজমকের সঙ্গে পালন করে। রাসলীলা বা ধর্মীয় নাটকগুলি কৃষ্ণের জীবন থেকে ঘটনাগুলি পুনর্নির্মাণ এবং রাধার প্রতি তাঁর ভালবাসার স্মরণে প্রদর্শিত হয়।পৃথিবীর সকল ধর্মই সাম্য, মানবতা, ভ্রাতৃত্ব আর ভালোবাসার কথা বলেছে। ধর্ম মানে ধারণ করা। অর্থাৎ প্রত্যেকটা ধর্ম সার কথা মানুষকে ভালোবাসা, মানুষকে সেবা করা, মানুষের পাশে দাঁড়ানো। মানবতাই শ্রেষ্ঠ ধর্ম। আমরা সকলে ধর্মকে পালন করি মনে প্রানে, অন্তরে, জীবনে প্রতিটি চলার পথে। সেখানে শুধুই মনুষ্যত্ব, মানবিকতা, পরধর্ম সহিষ্ণুতা, পরোপকারিতা, মহানুভবতা, উদারতা, সর্বোপরি বিশ্বমানবতা। পরিশেষে শতাব্দী প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে বিপর্যস্ত বিধ্বস্ত মানুষের জীবনে জন্মাষ্টমী নিয়ে আসুক শান্তি, সহিষ্ণুতা, মনুষ্যত্বের শাশ্বত বাণী।করোনাকালে জন্মাষ্টমীর প্রতিটি আয়োজন যেন সামাজিক ও শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে উদযাপিত হয়। স্বাস্থ্যবিধি মেনেই যেন সবাই ধর্মীয় বিধি বিধান অনুসরণ করেন। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সেই চিরায়ত বাণী আবারো স্মরন করি-” ধর্ম আনেনি মানুষ, মানুষ এনেছে ধর্ম।”মানুষের কল্যাণেই ধর্ম। মানুষের সুখে দুঃখে আনন্দে ধর্মীয় মহান আদর্শ আমাদের প্রত্যেককে মানবিক, সহনশীল ও প্রকৃত মানুষ করে তুলুক। তবেই ধর্মীয় উৎসব পালনের প্রাসঙ্গিকতা।
শিরোনাম: জন্মাষ্টমী পালনের প্রাসঙ্গিকতা ও তাৎপর্য।
পাভেল আমান- হরিহর পাড়া -মুর্শিদাবাদ
Leave a Reply