রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ১০:১০ অপরাহ্ন

শিরোনাম :
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ (কসবা-আখাউড়া) আসনে আইন মন্ত্রী আনিসুল হক বে-সরকারি ভাবে নির্বাচিত কসবায় ভোট দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ১ আহত-৪ কসবায় এলজিইডি’র শ্রেষ্ঠ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠান আগরতলায় স্রোত আয়োজিত লোকসংস্কৃতি উৎসব কসবা প্রেসক্লাব সভাপতি’র উপর হামলার প্রতিবাদে মানবন্ধন ও প্রতিবাদ সভা কসবায় চকচন্দ্রপুর হাফেজিয়া মাদ্রাসার বার্ষিক ফলাফল ঘোষণা, পুরস্কার বিতরণ ও ছবক প্রদান শ্রী অরবিন্দ কলেজের প্রথম নবীনবরণ অনুষ্ঠান আজ বছরের দীর্ঘতম রাত, আকাশে থাকবে চাঁদ বিএনপি-জামাত বিদেশীদের সাথে আঁতাত করেছে-কসবায় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ১৩ দিনের জন্য ভোটের মাঠে নামছে সশস্ত্র বাহিনী
বসন্তে রঙের উৎসব দোল বা হোলি

বসন্তে রঙের উৎসব দোল বা হোলি

দীপক সাহা।।

বসন্ত এসে গেছে। আর বসন্ত মানেই হল তো দোল যাত্রা।দোলযাত্রা মূলত একটি হিন্দু উৎসব বলেই বিবেচিত হয়। তাহলেও সর্ব ধর্মের মানুষের সান্নিধ্যের মধ্য দিয়েই উৎসবের আসল প্রাপ্তি। এই উৎসবের অপর নাম বসন্তোৎসব। ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে দোলযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। আবিরে ভেসে যাওয়া, রঙের খেলা, বাঙালির ইতিহাসে শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীচৈতন্যদেব সব মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।

দোল উৎসবের প্রাণকেন্দ্রে রয়েছেন রাধা-কৃষ্ণ। তাঁদেরকে দোলায় বসিয়ে পূজা করা হয়। উত্তর ভারতে যেটি হোলি নামে পরিচিত, বঙ্গদেশেই তার পরিচিত নাম দোল। আমাদের বঙ্গদেশে বৈষ্ণব ধর্মের প্রসারের ফলে রাধাকৃষ্ণের প্রেম, বসন্তের রাসলীলা ও হোলি সমার্থক হয়ে গিয়েছে৷ ইতিহাস থেকে জানা যায়, ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চলের প্রাচীন আরিয়ান জাতির কাছ থেকে এই উৎসবের জন্ম। হোলি উৎযাপনের ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায়, খ্রিস্টের জন্মেরও কয়েকশো বছর আগে থেকেই হোলি উদযাপিত হয়ে আসছে। এই উৎসবের নমুনা পাওয়া যায় খ্রিস্ট জন্মেরও প্রায় ৩০০ বছর আগের পাথরে খোদাই করা একটি ভাস্কর্যে। এই উৎসবের উল্লেখ রয়েছে হিন্দু পবিত্র গ্রন্থ বেদ এবং পুরাণেও। ৭০০ শতকে দিকে রাজা হর্ষবর্ধনের সময়ে সংস্কৃত ভাষায় লেখা একটি প্রেমের নাটিকাতেও হোলি উৎসবের বর্ণনা রয়েছে। পরে বিভিন্ন মন্দিরের গায়ে খোদাই করা চিত্রকর্মে হোলি খেলার নমুনা বিভিন্নভাবে ফুটে ওঠে।

হোলি শব্দটা এসেছে হিন্দি ‘হোলিকা-দহন’ থেকে। এই হোলিকা ছিলেন, দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপুর বোন। বিষ্ণুপুরাণের বর্ণনায় বিষ্ণুর চতুর্থ অবতার হিসেবে পাওয়া যায় নৃসিংহ বা নরসিংহ অবতারের নাম। ব্রহ্মার কাছ থেকে বকলমে অমরত্ব লাভের পর হিরণ্যকশিপু নিজেকে একচ্ছত্র সম্রাট বলে ভাবতে শুরু করেন এবং ক্রমেই অনমনীয় হয়ে উঠতে থাকেন। এ দিকে নারদের প্রশ্রয়ে থেকে হিরণ্যকশিপুর পুত্র প্রহ্লাদ বিষ্ণুভক্ত হয়ে ওঠেন। হিরণ্যকশিপুর কানে এই খবর যাওয়া মাত্র ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন তিনি এবং নিজের পুত্রকেই হত্যা করতে উদ্যোগী হন। অথচ কী আশ্চর্য, বিভিন্ন চেষ্টার পরেও অক্ষত থেকে যান প্রহ্লাদ!

অবশেষে ডাক পড়ে হিরণ্যকশিপুর বোন হোলিকার, আগুন যাকে স্পর্শ করতে পারে না৷ নির্ধারিত দিনে প্রহ্লাদকে কোলে নিয়ে লেলিহান আগুনে প্রবেশ করে হোলিকা৷ বিষ্ণুর আশীর্বাদে আগুন থেকে অক্ষত বেরিয়ে আসে প্রহ্লাদ, আর জীবন্ত দগ্ধ হয়ে যায় হোলিকা৷ পর দিন ফাল্গুন পূর্ণিমা৷ হোলিকার মৃত্যুতে খুশি মানুষের মধ্যে শুরু হয় রঙিন খুশির উৎসব ‘হোলি’৷ আগুনের গ্রাসে হোলিকার মৃত্যুর ঘটনাটিই ‘হোলিকা দহন’।

বাংলাতে উৎসবের এই অনুষঙ্গটিই হয়েছে ‘নেড়াপোড়া’ বা বুড়ির ঘর পোড়ানো| হোলিকা-বুড়ির ঘর তৈরির জন্য ব্যবহৃত হয় সমস্ত জঞ্জাল৷ কাগজের একটি ঘরে রূপকল্প, তার সঙ্গে যুক্ত হয় দরমা, খড়, খেজুরপাতা, কাঠকুটো বা শুকনো পাতা৷ আগুন হু হু করে জ্বলে উঠলে সকলে সমস্বরে বলে ওঠে ‘আজ আমাদের নেড়াপোড়া, কাল আমাদের দোল’৷ নেড়াপোড়ার প্রসাদটিও কিন্তু অভিনব৷ রাঙা আলু বা আলু ছুড়ে ফেলা হয় আগুনে, পরে সেগুলি সংগ্রহ করে তেল-নুন দিয়ে মেখে ভাগ করে খাওয়া৷ ভারতের কিছু অংশে হোলিকা দহন উৎসবকে ‘ছোটি হোলি’ বলা হয়৷ শীতকে বিদায় জানিয়ে রঙিন বসন্তকে আবাহন করার উৎসব এটি৷ সমাজতাত্ত্বিক গবেষকদের অনেকে বলেন নেড়াপোড়ার অন্য তাৎপর্যের কথা৷ শীতের পরে গ্রামেগঞ্জে মশার উপদ্রব বাড়ত, সে জন্যই বুড়ির ঘরের সঙ্গে পুড়িয়ে ফেলা হত সমস্ত আবর্জনা৷

ভারতের অনেক জায়গায়, বিশেষত দক্ষিণ ভারতে হোলিকা দহনকে ‘কাম দহন’-ও বলা হয়৷ কিন্তু হোলির সঙ্গে কাম কেন? সে আর এক কাহিনি৷ শুনলেই বোঝা যাবে এই যৌবনের ফাগুয়াতে শুধু মনই নয়, কোথাও যেন সূক্ষ্ম ভাবে মিশে রয়েছে শরীর| রঙ মাখানোর অছিলাতে নারী-পুরুষের পরস্পরকে স্পর্শ করে খানিক যৌনতার আস্বাদ নেওয়া!

কালিদাসের কুমারসম্ভব কাব্যে আছে, তারকাসুরকে বধ করার জন্য একজন মহাপরাক্রমশালী যোদ্ধার প্রয়োজন। দেবতারা স্থির করেন, দেবাদিদেব মহাদেব এবং উমার মিলনে যে সন্তান জন্ম নেবেন, তিনিই হবেন দেবসেনাপতি। কিন্তু সমস্যা হল মহাদেবকে নিয়ে। তিনি তখন বসেছেন গভীর তপস্যায়৷ উমা এলেন তাঁর কাছে কিন্তু ধ্যানমগ্ন ধূর্জটির সে দিকে কোনও হুঁশই নেই। উমা তখন শরণ নিলেন কামদেবের। আড়াল থেকে তিনি কামের তির ছুড়লেন মহাদেবের দিকে, ধ্যানভঙ্গ হল তাঁর। অকালে ধ্যানভঙ্গ হওয়ায় ক্রোধে ফেটে পড়লেন মহাদেব। চোখ খুলে সামনে মদনদেবকে দেখতে পেয়ে তাঁর তৃতীয় নয়নের আগুনে ভস্ম করে দিলেন কামদেব মদনকে। ওই ঘটনাকে স্মরণ করেই কোথাও কোথাও দোল বা হোলির আগের দিন ‘কাম-দহন’ উৎসব হয়।

মূলত পুরীতে দোলোৎসব ফাল্গুন মাসে প্রবর্তনের যে রেওয়াজ হয়, সেখান থেকেই বাংলায় চলে আসে এই সমারোহ। দোলযাত্রা বা হোলি উৎসব সংক্রান্ত পৌরাণিক উপাখ্যান ও লোককথাগুলো মূলত দুই প্রকার: প্রথমটি দোলযাত্রার পূর্বদিন পালিত বহ্ন্যুৎসব হোলিকাদহন বা মেড়াপোড়া সংক্রান্ত, এবং দ্বিতীয়টি রাধা ও কৃষ্ণের দোললীলা বা ফাগুখেলা কেন্দ্রিক কাহিনি।

বৈষ্ণব বিশ্বাস অনুযায়ী, ফাল্গুনী পূর্ণিমা বা দোলপূর্ণিমার দিন বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণ আবির ও গুলাল নিয়ে রাধিকা ও অন্যান্য গোপীগণের সঙ্গে রং খেলায় মেতেছিলেন। সেই ঘটনা থেকেই দোল খেলার উৎপত্তি হয়। দোলযাত্রার দিন সকালে তাই রাধা ও কৃষ্ণের মূর্তি আবির ও গুলালে স্নাত করে দোলনায় চড়িয়ে কীর্তনগান সহকারে শোভাযাত্রা বের করা হয়। এরপর ভক্তেরা আবির ও গুলাল নিয়ে পরস্পরের সঙ্গে রং খেলেন। দোল উৎসবের অনুষঙ্গে ফাল্গুনী পূর্ণিমাকে দোলপূর্ণিমা বলা হয়। আবার এই পূর্ণিমা তিথিতেই চৈতন্য মহাপ্রভুর জন্ম বলে একে গৌরপূর্ণিমা নামেও অভিহিত করা হয়।মায়াপুরে ইস্কন মন্দির প্রাঙ্গণে খুব জাঁকজমকপূর্ণ দোল উৎসব পালন করা হয়।

শান্তিনিকেতনে বিশেষ নৃত্যগীতের মাধ্যমে বসন্তোৎসব পালনের রীতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময়কাল থেকেই চলে আসছে। এখনো সেই ধারা অব্যাহত রয়েছে। রবি ঠাকুর ১৯২৫ সালে এই উৎসবের উদ্বোধন করেন। আদিবাসী ও অন্যান্যদের নিয়ে শুরু করা সেই দিনের উৎসব এখনো একই ভাবে রীতিনীতি অনুসরণ করে চলছে।
দোল বা হোলি ধর্মীয় অনুষঙ্গের আড়ালে থাকা এক সামাজিক অনুষ্ঠানও, যার সার্বজনীন আবেদন আছে। দোলযাত্রা উৎসবের একটি ধর্মনিরপেক্ষ দিকও রয়েছে। এখন আর শুধুমাত্র সনাতন ধর্মালম্বীদের মধ্যে হোলি খেলা নয়, বরং সব ধর্মের নারী পুরুষের মধ্যেই রং খেলার প্রবণতা দেখা যায়।

এই সংবাদটি শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




raytahost-demo
© All rights reserved © 2019
ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: Jp Host BD