বুধবার, ১৫ মে ২০২৪, ১০:৩০ অপরাহ্ন

শিরোনাম :
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ (কসবা-আখাউড়া) আসনে আইন মন্ত্রী আনিসুল হক বে-সরকারি ভাবে নির্বাচিত কসবায় ভোট দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ১ আহত-৪ কসবায় এলজিইডি’র শ্রেষ্ঠ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠান আগরতলায় স্রোত আয়োজিত লোকসংস্কৃতি উৎসব কসবা প্রেসক্লাব সভাপতি’র উপর হামলার প্রতিবাদে মানবন্ধন ও প্রতিবাদ সভা কসবায় চকচন্দ্রপুর হাফেজিয়া মাদ্রাসার বার্ষিক ফলাফল ঘোষণা, পুরস্কার বিতরণ ও ছবক প্রদান শ্রী অরবিন্দ কলেজের প্রথম নবীনবরণ অনুষ্ঠান আজ বছরের দীর্ঘতম রাত, আকাশে থাকবে চাঁদ বিএনপি-জামাত বিদেশীদের সাথে আঁতাত করেছে-কসবায় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ১৩ দিনের জন্য ভোটের মাঠে নামছে সশস্ত্র বাহিনী
৭ই মার্চের ভাষণ: রাজনীতির কবির অমর কবিতা

৭ই মার্চের ভাষণ: রাজনীতির কবির অমর কবিতা

এস এম শাহনূর

কবিতা হলো জীবন ও প্রকৃতির শব্দগুলোর অপূর্ব বিন্যাস। সে শব্দগুলো হতে পারে প্রেমের, বেদনার, সংগ্রামের, যুদ্ধের, স্বাধীনতার, মানবতার, স্বপ্নের অথবা বেঁচে থাকার। একটি ভাল কবিতার অনন্য মহিমা হলো এর সর্বজনীনতা ও মানবিকতা।
‘স্বাধীনতা তুমি রবি ঠাকুরের অজর কবিতা…’। ‘আজো আমি বাতাসে লাশের গন্ধ পাই…’। ‘চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা…’। একটি ভালো কবিতা চিরকাল বেঁচে থাকে মানুষের মুখে মুখে।১০ লাখ মানুষের সামনে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণও এমনি এক অমর কবিতা। অনবদ্য, অভূতপূর্ব! এটি শুধু একটি ভাষণ নয়। অবশ্যই তার চেয়ে বেশি কিছু। এটি একটি কালোত্তীর্ণ কবিতা। এটি সর্বজনীন। ৫০ বছরেও এই ভাষণের আবেদন এতটুকু কমেনি।বারবার কেবল শুনতে ইচ্ছে করে।
নির্মলেন্দু গুণের কবিতাটি প্রধানত নির্ভুল অক্ষরবৃত্ত ছন্দে লেখা।
শ্রোতারা বসে আছে,
কখন আসবে কবি?
‘শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে
রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে
অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন।’

শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে কবি যখন এসে গেলেন, তখন অক্ষরবৃত্ত হয়ে গেল মাত্রাবৃত্ত—
‘তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল
হৃদয়ে লাগিল দোলা।’
৭ মার্চের প্রেক্ষাপট হঠাৎ করেই তৈরি হয়নি। পাকিস্তান শাসনকাল ধরলেও দুই যুগের ইতিহাস। ’৪৮, ’৫২, ’৬২, ’৬৬, ’৬৯ ও ১৯৭১।
হাজার বছর আগে চর্যাপদের কবি কাহ্নপা লিখেছিলেন বন্ধন ছিন্ন করার কথা—
‘এবংকার দৃঢ় বাখোড় মোড়িঅ।
বিবিহ বিআপক বান্ধন তোড়িঅ।’
‘১২০৬ খৃস্টাব্দে ভারতবর্ষে স্বাধীন মুসলমান শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। ইহার মধ্যে বাঙালি স্বাধীন বা কার্যত স্বতন্ত্র ছিল ৪২৬ বছর।’ [নির্বাচিত প্রবন্ধ।। নীরদ চন্দ্র চৌধুরী] কবি রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় ১৮৮৭ সালে মারা যাওয়া আগেই লিখে গেছেন ‘স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে’।
আর শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে কবি শোনালেন তাঁর অমর কবিতাখানি—
‘“এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”
সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের।’

এই কবিতাটি লিখিত হওয়ার পর থেকে কবিহীন বিমুখ প্রান্তরে উদ্যানের বিরুদ্ধে উদ্যান, বিকেলের বিরুদ্ধে বিকেল কিংবা মার্চের বিরুদ্ধে মার্চকে মার্চ করানোর সব ষড়যন্ত্র, অপপ্রয়াস ব্যর্থ হতে লাগল।
যতই দিন যাচ্ছে, বঙ্গবন্ধু ততই উজ্জ্বল হচ্ছেন। ২০০৮ সালে বিবিসি বাংলার বিশ্বব্যাপী জরিপে বঙ্গবন্ধু সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি নির্বাচিত হয়েছেন।

আরও বড় একটি স্বীকৃতি! ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর ইউনেস্কো এ ভাষণকে ‘ডকুমেন্টরি হেরিটেজ (বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য)’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ইউনেস্কোর ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্ট্রারে (এমওডব্লিউ)’ ৭ মার্চের ভাষণ সংগৃহীত হয়।

ইতিহাস বলে—-
✪ শ্রেষ্ঠ ভাষণমাত্রই মুহূর্তে মানুষকে উজ্জীবিত করে।
‘তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো৷ মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেবো- এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো, ইনশাল্লাহ।’ তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে একসাগর রক্তের বিনিময়ে বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল এদেশের মানুষ।

✪ লক্ষ্য অর্জনের সঠিক দিক নির্দেশনা।

৭ মার্চের ভাষণে লক্ষ্যের কথা বঙ্গবন্ধু স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন। লক্ষ্য হলো: মুক্তি ও স্বাধীনতা।

✪ শোষণ থেকে মুক্তি পেতে কী করণীয়।
ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু, আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তোমরা বন্ধ করে দেবে।’

✪ ভাষণের শব্দপ্রয়োগ, বাক্যবিন্যাস ও কাব্যময়তা সবাইকে মুগ্ধ করে। এর শ্রুতিমধুরতা শ্রোতাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে। স্বতঃস্ফূর্তভাবে হৃদয় থেকে উৎসারিত হয় শ্রেষ্ঠ ভাষণ। এবং সেটা তাৎক্ষণিক ও পরিস্থিতির চাহিদায়। একথা অনেকেরই অজানা নয়, ৭ মার্চের ভাষণ ছিল নাতি দীর্ঘ ও অলিখিত ।

‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ থেকে বঙ্গবন্ধুর সংগীতপ্রীতি,সংগীতশিল্পী আব্বাসউদ্দীন আহমদের সাক্ষাৎ এবং সুফি-সাধকদের মাজারে গিয়ে গান শোনার অভিজ্ঞতার তথ্য লাভ করা যায়। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের মধ্যদিয়ে তাঁর লেখক সত্তাও প্রস্ফুটিত হয়। সাহিত্যমূল্যের বিচারে কাব্যিক ছন্দের সেই ভাষণকে ‘দীর্ঘ কবিতা’ বলা যায়। দীর্ঘ কবিতার ভাষণকে কেন্দ্র করে রচিত হচ্ছে অনেক কবিতা,গান, পুথি,গল্প, সিনেমা,নাটক ও সাহিত্যকর্ম। কেননা ‘কোনো কোনো বক্তৃতায় জাদুর প্রভাব রয়েছে’ কথাটার সত্যতা এ থেকেই প্রমাণ হয়। এ পর্যন্ত ১২টি ভাষায় অনুবাদ হয়েছে এই ভাষণ।

ভাষণের প্রথম শব্দযুগল ছিল, ‘ভা(ই)য়েরা আমার’। এরপর শুরু করলেন তার ভাষণ এক সহজাত ভঙ্গীমায়।

দ্বিতীয় বাক্যটি ছিল, ‘আজ দু:খ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের মাঝে হাজির হয়েছি’। এর মাধ্যমে তিনি অব্যক্ত কিন্তু সুষ্পষ্টভাবেই সেদিনের মহাসমাবেশের প্রেক্ষাপটটি বলে দিলেন কবি।

‘আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন’ এর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু আমাদের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটটিকে আর একবার মনে করিয়ে দিলেন।

ভাষণের প্রায় শুরুতেই বলেছেন ‘২৩ বৎসরের করুণ ইতিহাস বাংলার অত্যাচারের, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস। ২৩ বৎসরের ইতিহাস মুমূর্ষু নর–নারীর আর্তনাদের ইতিহাস।’ এরপর তিনি কবিতার মতো পাঠ করতে থাকলেন ওই সময়ের প্রেক্ষাপট।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে সারা পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল। কিন্তু পাকিস্তানের জেনারেল আর রাজনীতিকেরা গোপন বৈঠকে ঠিক করেছে নির্বিচারে বাঙালি হত্যা করবে, তবু ক্ষমতা দেবে না। এদিকে বঙ্গবন্ধু স্পষ্ট বলে দিয়েছেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না, এ দেশের মানুষের অধিকার চাই।’

বললেন,‘আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার মানুষকে হত্যা করা হয়, তোমাদের উপর আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।’

‘তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না।’ আবার বললেন ‘এই বাংলার হিন্দু-মুসলিম, বাঙালি-ননবেঙ্গলি যারা আছে তারা আমাদের ভাই, তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের ওপরে, আমাদের যেন বদনাম না হয়।’ ইঙ্গিত দিয়ে রাখলেন, ‘আমি যদি হুকুম দিবার না-ও পারি’…বললেন, ‘যদি এ দেশের মানুষকে খতম করার চেষ্টা করা হয়, বাঙালিরা বুঝেশুনে কাজ করবেন…তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাক। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশা আল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘আমরা সংখ্যায় মেজরিটি, কিন্তু একজন মানুষও যদি ন্যায্য কথা বলে আমরা তা মেনে নেবে।’ এর চেয়ে আর বড় কোনো গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ হতে পারে না৷

➤শেখ মুজিবুর রহমান যখন বঙ্গবন্ধু হননি তখনও তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও বাঙালির মুক্তির স্বপ্নে বিভোর ছিলেন। বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন বাংলার সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা।

১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ। স্থান ঢাকার রেসকোর্স ময়দান (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান)। বিকেল ৩টা ২০ মিনিট। সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি আর হাতাকাটা কালো কোট পরে মঞ্চে ওঠেন বাঙালির স্বপ্নসারথি বঙ্গবন্ধু। সেদিন বিশাল জনসমুদ্রে ছিল মুহুর্মুহু স্লোগানের ঢেউ…। সপ্তর্ষির মতো আলোকময় এক রাজনীতির কবি বাঙালির সাতপুরুষের লালিত সাতরঙা স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষার সাতসুরে বাঁধা কবিতা পাঠ করলেন। হঠাৎ পিনপতন নীরবতা। তাঁর সেই ‘শাণিত কথার ঝলসানো লাগা সতেজ ভাষণ’ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ কবিতা। এই কবিতা সমগ্র বাংলাদেশকে একটিমাত্র স্বপ্নে উদ্বুদ্ধ করেছিল, মুক্তিকামী বাঙালি জাতিকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো জাগিয়ে তুলেছিল, একদেহ একপ্রাণ হয়ে উঠেছিল দেশ, আর ‘একটি মজিবরের থেকে লক্ষ মজিবরের’ কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল একটিমাত্র ধ্বনি—বাংলাদেশ। পুরো কবিতায় ছিল সাত সাগরের গর্জন। ভাষণের ব্যাপ্তি ১৮ মিনিট মাত্র। তাৎপর্য ব্যাপক, বহুমাত্রিক। শব্দ সংখ্যা ১১০৫ (এক হাজার একশত পাঁচ)। প্রতিটি শব্দ কী যথাযথ। কী সব কথামালা! যেন খোদাই করা একেকটা বাক্য। ব্যঞ্জনায় পূর্ণ, গীতিময়। মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে। আবিষ্ট হয়ে বার বার শুনতে ইচ্ছে করে। আর প্রতিবারই নতুন মনে হয়।আজও যখন এই ভাষণ কোথাও বাজে বাঙালির হৃদয়ে উদ্দীপনা জাগায়।বিশ্ব মানবতার মুক্তির সংগ্রামে যুগে-যুগে অনুপ্রেরণা জোগাবে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ। সিন্ধুকে কখনও বিন্দুতে ধারণ করা যায় না।
কোনো অভিধানের অক্ষর, শব্দ, বাক্যের সাধ্য কী তাকে বর্ণনা করে। তবে প্রেরণার এই আধার থেকে অফুরন্ত অনুপ্রেরণা নিতে পারি আমরা।

১৯৭১ সালের মার্চের শেষ দিকে শুরু হয় প্রচণ্ড যুদ্ধ। যুদ্ধের বছর ৫ এপ্রিল আমেরিকার বিশ্বখ্যাত সময়িকী ‘নিউজ উইক’ তাদের প্রচ্ছদে বঙ্গবন্ধুকে ‘রাজনীতির কবি’ বা ‘দ্য পয়েট অব পলিটিকস’ বলে অবিহিত করে।

কবি নির্মলেন্দু গুণ তাঁর একটি বিখ্যাত কবিতা, ‘স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো’ কবিতার প্রায় শুরুতেই তিনি বঙ্গবন্ধুকে কবি বলেছেন। তিনি বলেছেনে, ‘কখন আসবে কবি’।
কবিতার একেবারে শেষে পঙক্তিতে লিখেছেন, ‘শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে/ রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্তপায়ে হেঁটে/ অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন…’। একবার জাতীয় কবিতা পরিষদের শিরোনাম ছিল, কবি মুহাম্মদ সামাদের কবিতার পঙক্তি দিয়ে, ‘মুজিব আমার স্বাধীনতার অমর কাব্যের কবি।’
আহমদ ছফা লিখেছিলেন, ‘বাঙালির শ্রেষ্ঠ কাব্য চর্যাপদ নয়, বৈষ্ণব গীতিকা নয়, সোনার তরী কিংবা গীতাঞ্জলি কোনোটা নয়, বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ কাব্যগীতি হলো ‘আর দাবায় রাখতে পারবা না।’

৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু বাঙালির দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস, আন্দোলনের রূপরেখা, যুদ্ধের কৌশল, গরিবের কষ্ট, শত্রু বাহিনীর অনুপ্রেবেশ, সব সম্প্রদাকে সঙ্গে রাখা, সতর্ক থাকা—১৮ মিনিটের তাৎক্ষণিক ও অলিখিত ভাষণটি ছিল বাঙালির স্বাধীনতার দিকনির্দেশনা ও শ্রেষ্ঠ কাব্যগাথা।

জীবনানন্দ দাশ বলেছিলেন, ‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি।’ কারণ কবির মধ্যে বিগত কয়েক শতাব্দীর এবং সমকালের কবিতার ইতিহাসটা ক্রিয়া করে। ‘একজন কবি মানুষের মনের কথা বললেন কি না তা সবসময় গুরুত্বপূর্ণ নয়। তিনি কিভাবে বলেন, কোন আচার-ভঙ্গিতে বলেন, তা অনেক বেশি গুরত্বপূর্ণ।’
‘বঙ্গবন্ধুর ভাষণের প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্যই যেন অনিবার্য। এর প্রতিটি শব্দে লুকিয়ে আছে এ দেশের মানুষের স্বপ্ন, সংগ্রাম, যুদ্ধ, স্বাধীনতা, মানবতা, বেঁচে থাক। এ যেন বাঙালির অবিনাশী গান। প্রায় যেকোনো বিবেচনায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ একটি অমর কবিতা। কোনো ভালো কবিতায় একটা শব্দও কম বা বেশি থাকে না। প্রতিটি শব্দকেই হতে হয় অবশ্যম্ভাবী। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে যেন একটা কথাও কম-বেশি বলা হয়নি। একটা শব্দও ভুল বলা হয়নি। ১৮ মিনিটের এই ভাষণটি কোনো সাধারণ বক্তৃতা ছিল না। এটি ছিল স্বাধীনতার চেতনায় মগ্ন এক অবিসংবাদী নেতার হৃদয়নিংড়ানো অভিব্যক্তি। একটি অমর কবিতা।’

কেমন ছিল সেদিন ঢাকার হৃদয়মাঠখানি?
সেই ভাষণ শোনার স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে কবি নির্মলেন্দু গুণ লিখেছেন, ‘মনে হয়, অব্যাখ্যাত অলৌকিক শক্তির ওপর বঙ্গবন্ধু কিছুটা আস্থাশীল ছিলেন। তাঁর ৭ মার্চের ভাষণটি শুনেও আমার সে কথাই মনে হয়েছিল। মনে হচ্ছিল ভেতর থেকে যেন কেউ শব্দের পর শব্দ, বাক্যের পর বাক্য, বেস্ট ওয়ার্ড ইন বেস্ট অর্ডারে তাঁর কণ্ঠে যুগিয়ে দিচ্ছিল। আর জলপ্রপাতের মতো তাঁর কণ্ঠ থেকে নেমে আসছিল অনর্গল শব্দঝরণা। ১০৩ পঙ্ক্তির কাব্যগুণান্বিত ওই ভাষণের রচয়িতাকে যদি আমরা কবি হিসেবে স্বীকৃতি দিতে কার্পণ্য করি, তাহলে তা খুবই অন্যায় হবে। তাঁর ওই ভাষণ নিয়ে লেখা আমার বহুশ্রুত “স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো” নামক কবিতায় বঙ্গবন্ধুকে আমি কবি হিসেবেই বর্ণনা করেছি। জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকতে অধীর আগ্রহে ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা সেদিন ভোর থেকে যাঁর অপেক্ষায় বসেছিল, তিনি কবি। কখন আসবে কবি?’ (আত্মকথা ১৯৭১ , বাংলাপ্রকাশ)
নির্মলেন্দু গুণের কবিতাটি প্রধানত নির্ভুল অক্ষরবৃত্ত ছন্দে লেখা।
শ্রোতারা বসে আছে,
কখন আসবে কবি?
‘শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে
রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে
অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন।’

শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে কবি যখন এসে গেলেন, তখন অক্ষরবৃত্ত হয়ে গেল মাত্রাবৃত্ত—
‘তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল
হৃদয়ে লাগিল দোলা।’
৭ মার্চের প্রেক্ষাপট হঠাৎ করেই তৈরি হয়নি। পাকিস্তান শাসনকাল ধরলেও দুই যুগের ইতিহাস। ’৪৮, ’৫২, ’৬২, ’৬৬, ’৬৯ ও ১৯৭১।
হাজার বছর আগে চর্যাপদের কবি কাহ্নপা লিখেছিলেন বন্ধন ছিন্ন করার কথা—
‘এবংকার দৃঢ় বাখোড় মোড়িঅ।
বিবিহ বিআপক বান্ধন তোড়িঅ।’
‘১২০৬ খৃস্টাব্দে ভারতবর্ষে স্বাধীন মুসলমান শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। ইহার মধ্যে বাঙালি স্বাধীন বা কার্যত স্বতন্ত্র ছিল ৪২৬ বছর।’ [নির্বাচিত প্রবন্ধ।। নীরদ চন্দ্র চৌধুরী] কবি রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় ১৮৮৭ সালে মারা যাওয়া আগেই লিখে গেছেন ‘স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে’।
আর শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে কবি শোনালেন তাঁর অমর কবিতাখানি—
‘“এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”
সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের।’

এই কবিতাটি লিখিত হওয়ার পর থেকে কবিহীন বিমুখ প্রান্তরে উদ্যানের বিরুদ্ধে উদ্যান, বিকেলের বিরুদ্ধে বিকেল কিংবা মার্চের বিরুদ্ধে মার্চকে মার্চ করানোর সব ষড়যন্ত্র, অপপ্রয়াস ব্যর্থ হতে লাগল।
যতই দিন যাচ্ছে, বঙ্গবন্ধু ততই উজ্জ্বল হচ্ছেন। ২০০৮ সালে বিবিসি বাংলার বিশ্বব্যাপী জরিপে বঙ্গবন্ধু সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি নির্বাচিত হয়েছেন।

আরও বড় একটি স্বীকৃতি! ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর ইউনেস্কো এ ভাষণকে ‘ডকুমেন্টরি হেরিটেজ (বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য)’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ইউনেস্কোর ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্ট্রারে (এমওডব্লিউ)’ ৭ মার্চের ভাষণ সংগৃহীত হয়।

ইতিহাস বলে—-
✪ শ্রেষ্ঠ ভাষণমাত্রই মুহূর্তে মানুষকে উজ্জীবিত করে।
‘তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো৷ মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেবো- এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো, ইনশাল্লাহ।’ তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে একসাগর রক্তের বিনিময়ে বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল এদেশের মানুষ।

✪ লক্ষ্য অর্জনের সঠিক দিক নির্দেশনা।

৭ মার্চের ভাষণে লক্ষ্যের কথা বঙ্গবন্ধু স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন। লক্ষ্য হলো: মুক্তি ও স্বাধীনতা।

✪ শোষণ থেকে মুক্তি পেতে কী করণীয়।
ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু, আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তোমরা বন্ধ করে দেবে।’

✪ ভাষণের শব্দপ্রয়োগ, বাক্যবিন্যাস ও কাব্যময়তা সবাইকে মুগ্ধ করে। এর শ্রুতিমধুরতা শ্রোতাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে। স্বতঃস্ফূর্তভাবে হৃদয় থেকে উৎসারিত হয় শ্রেষ্ঠ ভাষণ। এবং সেটা তাৎক্ষণিক ও পরিস্থিতির চাহিদায়। একথা অনেকেরই অজানা নয়, ৭ মার্চের ভাষণ ছিল নাতি দীর্ঘ ও অলিখিত ।

‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ থেকে বঙ্গবন্ধুর সংগীতপ্রীতি,সংগীতশিল্পী আব্বাসউদ্দীন আহমদের সাক্ষাৎ এবং সুফি-সাধকদের মাজারে গিয়ে গান শোনার অভিজ্ঞতার তথ্য লাভ করা যায়। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের মধ্যদিয়ে তাঁর লেখক সত্তাও প্রস্ফুটিত হয়। সাহিত্যমূল্যের বিচারে কাব্যিক ছন্দের সেই ভাষণকে ‘দীর্ঘ কবিতা’ বলা যায়। দীর্ঘ কবিতার ভাষণকে কেন্দ্র করে রচিত হচ্ছে অনেক কবিতা,গান, পুথি,গল্প, সিনেমা,নাটক ও সাহিত্যকর্ম। কেননা ‘কোনো কোনো বক্তৃতায় জাদুর প্রভাব রয়েছে’ কথাটার সত্যতা এ থেকেই প্রমাণ হয়। এ পর্যন্ত ১২টি ভাষায় অনুবাদ হয়েছে এই ভাষণ।

ভাষণের প্রথম শব্দযুগল ছিল, ‘ভা(ই)য়েরা আমার’। এরপর শুরু করলেন তার ভাষণ এক সহজাত ভঙ্গীমায়।

দ্বিতীয় বাক্যটি ছিল, ‘আজ দু:খ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের মাঝে হাজির হয়েছি’। এর মাধ্যমে তিনি অব্যক্ত কিন্তু সুষ্পষ্টভাবেই সেদিনের মহাসমাবেশের প্রেক্ষাপটটি বলে দিলেন কবি।

‘আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন’ এর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু আমাদের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটটিকে আর একবার মনে করিয়ে দিলেন।

ভাষণের প্রায় শুরুতেই বলেছেন ‘২৩ বৎসরের করুণ ইতিহাস বাংলার অত্যাচারের, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস। ২৩ বৎসরের ইতিহাস মুমূর্ষু নর–নারীর আর্তনাদের ইতিহাস।’ এরপর তিনি কবিতার মতো পাঠ করতে থাকলেন ওই সময়ের প্রেক্ষাপট।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে সারা পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল। কিন্তু পাকিস্তানের জেনারেল আর রাজনীতিকেরা গোপন বৈঠকে ঠিক করেছে নির্বিচারে বাঙালি হত্যা করবে, তবু ক্ষমতা দেবে না। এদিকে বঙ্গবন্ধু স্পষ্ট বলে দিয়েছেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না, এ দেশের মানুষের অধিকার চাই।’

বললেন,‘আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার মানুষকে হত্যা করা হয়, তোমাদের উপর আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।’

‘তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না।’ আবার বললেন ‘এই বাংলার হিন্দু-মুসলিম, বাঙালি-ননবেঙ্গলি যারা আছে তারা আমাদের ভাই, তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের ওপরে, আমাদের যেন বদনাম না হয়।’ ইঙ্গিত দিয়ে রাখলেন, ‘আমি যদি হুকুম দিবার না-ও পারি’…বললেন, ‘যদি এ দেশের মানুষকে খতম করার চেষ্টা করা হয়, বাঙালিরা বুঝেশুনে কাজ করবেন…তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাক। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশা আল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘আমরা সংখ্যায় মেজরিটি, কিন্তু একজন মানুষও যদি ন্যায্য কথা বলে আমরা তা মেনে নেবে।’ এর চেয়ে আর বড় কোনো গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ হতে পারে না৷
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ কেন ‘বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য’র স্বীকৃতি পেয়েছে? এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে স্বীকৃতিপ্রাপ্তির সময় সে সময়ের ইউনেস্কো মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভার বক্তব্য।
এই ভাষণে সামরিক আইন প্রত্যাহার, সেনাবাহিনীর ব্যারাকে ফেরানো, শহীদদের জন্য ক্ষতিপূরণ ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতার দাবি জানান বঙ্গবন্ধু। এছাড়াও ভাষণে মনকাড়া অনেকগুলো বিষয় আছে। এতে কৌশলে বঙ্গবন্ধু নিরস্ত্র জনগোষ্ঠীকে কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়নে সশস্ত্র সংগ্রামে অংশ নেওয়ার কথা বলে দিয়েছেন। পাশাপাশি রয়েছে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের কথা। ‘যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও একজন যদিও সে হয়, তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব’। আছে মানবিকতার কথা। ‘গরিবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে, সেইজন্য সমস্ত অন্যান্য জিনিসগুলো আছে, সেগুলোর হরতাল কাল থেকে চলবে না। রিকশা ঘোড়াগাড়ি চলবে, রেল চলবে, লঞ্চ চলবে।’ রয়েছে অসাম্প্রদায়িক আদর্শ ও সম্প্রীতির উল্লেখ। ‘এই বাংলায় হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি-নন বাঙালি যারা আছে তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের উপরে’। আছে শান্তিপূর্ণ উপায়ে বাঙালির অধিকার আদায়ের প্রচেষ্টার কথা। এবং সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার কথা। ‘আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়।’

অন্নদাশঙ্কর রায়ের মতো আমারও বিশ্বাস- ‘যত দিন রবে পদ্মা মেঘনা/ গৌরী যমুনা বহমান/ তত দিন রবে কীর্তি তোমার/ শেখ মুজিবুর রহমান।’

লেখক: এস এম শাহনূর
কবি ও আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক

এই সংবাদটি শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




raytahost-demo
© All rights reserved © 2019
ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: Jp Host BD