মঙ্গলবার, ২২ এপ্রিল ২০২৫, ০১:২৪ অপরাহ্ন

শিরোনাম :
রমনিতা,শরব জনজাতির এক প্রেরণার নাম

রমনিতা,শরব জনজাতির এক প্রেরণার নাম

– দীপক সাহা
‘দিন আনি দিন খাই’য়ের সংসার। টালির চাল দিয়ে বৃষ্টির জল পড়ে ঘরের মধ্যে। রমনিতা শবর, পিতা মহাদেব শবর। গ্রাম-ফুলঝোর; পোষ্ট -ফুলঝোর; ব্লক + থানা-বরাবাজার; জেলা -পুরুলিয়া। এতদিন এই পরিচয় থাকলেও সবচেয়ে বড় পরিচয় ছিল,’ওহ শবরদের মেয়ে’! সংসার চলে চাষ করে। তবে, আর্থিক অনটন সত্ত্বেও বাবা মহাদেব শবর এবং মা বেহুলা শবর মেয়েকে শিক্ষিত করার জন্য, দিন রাত এক করে দিয়েছেন। তারই ফসল,এই প্রথম পুরুলিয়ার ফুলঝোর গ্রামের শবর প্রজাতির কোন মেয়ে ইতিহাসে সাম্মানিক স্নাতক হলেন ঝাড়খণ্ড রাজ্যের পটমদা ডিগ্রি কলেজ থেকে। ভবিষ্যতে স্নাতকোত্তর করে কলেজে পড়াতে চান তিনি। পিছিয়ে পড়া শবর জনজাতি থেকে আসা রমনিতার শিক্ষাঙ্গনে উজ্জ্বল কীর্তি নিঃসন্দেহে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

শবর একটি জনগোষ্ঠীর নাম। শবর কথাটির উৎপত্তি হয়েছে ‘সগর’ থেকে। স্কাইথিয়ান ভাষায় ‘সগর’ শব্দের অর্থ হলো কুঠার। শবররা কুঠার হাতে বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতেন। সেখান থেকেই শবর নামটির প্রচলন হয়। শবররা বাস করেন পশ্চিম বাংলা,তামিলনাড়ু , মধ্যপ্রদেশ, ছোটনাগপুর আর উড়িষ্যায়। ইদানীং ত্রিপুরা জেলাতেও কয়েক ঘর শবরের সন্ধান পাওয়া গেছে। ব্রিটিশ শাসনের মাঝামাঝি শবররা বাংলাদেশের দিকে ছড়িয়ে পড়েন। আজকের দিনে শবরদের অবস্থা যা-ই হোক না কেন, শবরদের অতীত অনেক গৌরবের। প্রাচীন মহাকাব্য মহাভারত, রামায়ণ, হর্ষচরিত, চর্যাপদ আর পুরাণে শবরদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সাহিত্য কিংবা লোকগাঁথা ছাড়াও ধর্মচর্চায়ও শবররা মর্যাদার দাবিদার। জনশ্রুতি পুরীর জগন্নাথ নাকি এই শবরদেরই দেবতা। চর্যাপদে শবরদের সম্পর্কে লেখা আছে, “উঁচা উঁচা পাবত তোঁহি বসতি শবরী বালি”।

এককালে মাথা উঁচিয়ে বেঁচে থাকা শবরদের বর্তমান অবস্থা কেমন? প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের চলে যেতে হবে ভারতবর্ষের ব্রিটিশ শাসনকালে। কেননা তখনই প্রথম শবরদের জাতিগত অস্তিত্বে আঘাত আসে।বন থেকে বিভিন্ন আদিবাসী ও নৃ-গোষ্ঠীদের উচ্ছেদ করতে থাকে ইংরেজরা। কেড়ে নেওয়া হয় জঙ্গলের ওপর তাঁদের পরম্পরার অধিকার। অরণ্যের গভীরে বাস করা শবররা তখন দিশেহারা হয়ে পড়েন। কেউ বেছে নেন যাযাবর জীবন। অভাব-অনটন আর কাজের অভাবে অনেকেই বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজকর্মে জড়িয়ে পড়েন। ক্রুদ্ধ ইংরেজরা ১৯১৬ সালে শবরসহ বেশ কিছু জাতিকে ‘অপরাধপ্রবণ আদিবাসী’ হিসেবে চিহ্নিত করে। সেই চিহ্ন তাঁরা আজও বয়ে বেড়াচ্ছে কোনো কারণ ছাড়াই।

শবররা যে শুধু ইংরেজদের অত্যাচারের সম্মুখীন হয়েছে তা নয়। তাঁরা নিপীড়িত হয়েছেন নিজেদের মানুষদের দ্বারাই। বর্ণবাদী হিন্দু, সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদী শক্তির সাথে শবরদের লড়তে হচ্ছে নিত্যদিন। ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের পর ভারত সরকার তাদের ‘ডিনোটিফাইড ট্রাইব’ বা বিমুক্ত জাতি হিসেবে ঘোষণা করে। কিন্তু তাতে বিশেষ কোনো লাভ হয় না। অস্পৃশ্য হিসেবে আখ্যায়িত করে শবরদের সমস্ত সামাজিক কার্যক্রম থেকে আলাদা করে দেওয়া হয়েছে। তাই মূল সমাজ থেকে তাঁরা এখনও অনেক দূরে। জঙ্গলনির্ভর শবররা এখন বেশিরভাগই কর্মহীন। কৃষিকাজ বা পশুপালনের কাজে তাঁরা অভ্যস্ত নন। ফলে অধিকাংশই অনাহারে জর্জরিত জীবনযাপন করেন। তাঁদের শবরত্ব ঘুচে গেছে বহু বছর আগেই। তথাকথিত সভ্যজাতির ঝলকানিতে শবররা তাঁদের নিজেদের ভাষাও হারিয়ে ফেলেছেন। জঙ্গল হারিয়ে ফেলে তাঁরা ক্রমশ ইনসাইডার থেকে আউটসাইডার হয়ে গেছেন।

উল্লেখ্য এর আগে ১৯৮৫ সালে মেদিনীপুরের চুনী কোটাল প্রথম আদিম জনজাতির কন্যা হিসেবে স্নাতক হয়েছিলেন। তিনি বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নৃবিদ্যায় স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। স্নাতক ডিগ্রী লাভের দুই বছর পর, তিনি মেদিনীপুরের ‘রানি শিরোমনি এসসি এন্ড এসটি গার্লস’ হোস্টেলের হোস্টেল সুপারিনটেনডেন্ট হিসাবে নিযুক্ত হন। সরকারি চাকরি।কিন্তু লোধা প্রজাতির নিচু মেয়ের এতটা এগিয়ে আসা সহ্য হয়নি অনেকেরই। দিনের পর দিন ব্যঙ্গ, টিটকিরি সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলেন চুনি। চুনি কোটালের আত্মহত্যা তৎকালীন সমাজ ও সরকারের বর্ণভেদ, নিপীড়ন এবং অনুভূতিহীন অযত্নের মুখোশ খুলে দেয়।

তথাকথিত সুবিধাভোগকারী জাতের দ্বারা তথাকথিত বঞ্চিত জাতের মানুষদের ওপর পাশবিক নির্যাতন শতাব্দীর পর শতাব্দী ঘটে চলেছে। বর্ণবিদ্বেষের শিকার কখনো আমেরিকা, কখনো আফ্রিকা, কখনো ভারত। ভারতের মাটিতে শূদ্রদের ওপর মধ্যযুগে বর্বরতা চালানোর ঘটনাও সকলের জানা। এখনও ভারতের নানা প্রান্তে তথাকথিত উচ্চ বর্ণের মানুষেরা দলিতদের ওপর নৃশংসভাবে অত্যাচারের কাহিনি প্রায়ই টিভির পর্দায় আছড়ে পড়ে। আজ থেকে কয়েক দশক পূর্বে তথাকথিত নীচু জাতির কয়েকটি বিশেষ সম্প্রদায় মূলত দলিত, শবর ও কোটালদের শিক্ষা-দীক্ষা, পুঁজি, চাকরির সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হত। বামুনদের পুকুর কিংবা কুয়োতে জল স্পর্শ করলে তাঁকে গণধোলাই দেওয়া হত৷ ধর্মীয় স্থানে উঠতে দেওয়া হত না।মেয়েদের ক্ষেত্রে তো জুটত আরও বেশি লাঞ্ছনা। স্কুলে যেতে দেওয়া হত না, খুব কম বয়সে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হত। বিদ্যালয়ে গেলে বিভিন্ন ভাবে অপদস্থ হতে হত শিক্ষক ও তথাকথিত উচ্চ বর্ণের ছাত্রছাত্রীর কাছ থেকে। বিভিন্ন ভাবে মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করতে হত। দলিত সম্প্রদায়ের হওয়ায় বিদ্যালয়ে গেলে বলা হত– ‘তোরাও লেখাপড়া করবি?’ অনেকে মনে করেন, সকলের শিক্ষাসহ আর্থ-সামাজিক অধিকার এখনও সমাজ ও রাষ্ট্র কার্যত স্বীকার করে না। তবে আশার কথা পরিস্থিতি আস্তে আস্তে বদলাচ্ছে। অতীতের সমস্ত গ্লানি ও মিথ্যা অভিযোগকে মাড়িয়ে তথাকথিত সভ্যজাতির সঙ্গে পাল্লা দিতে এগিয়ে আসছে শবর জনজাতি।
মেদিনীপুর জেলার বর্তমান ঝাড়গ্রাম ও পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার একটি বিস্তীর্ণ অংশ জুড়ে বসবাস করেন লোধা শবর সম্প্রদায়ের মানুষ। দারিদ্র, তথাকথিত উচ্চ বর্ণের মানুষদের বৈষম্য ও অনুন্নয়নের কারণে শবর সম্প্রদায়ের মানুষকে আজও লড়াই করতে হয়। এই সমস্ত মানুষকে দুবেলা ভাত ও সামাজিক বঞ্চনার সাথে লড়াই করতে হয় প্রতিদিন। প্রসিদ্ধ কথাসাহিত্যিক ও মানবাধিকার আন্দোলনকর্মী মহাশ্বেতা দেবী শবরদের জন্য আমৃত্যু লড়াই ও সংগ্রাম করেছেন। সময় বদলেছে। বর্তমানে সরকারও শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কৃষি-সহ নানান প্রকল্প চালু করেছেন শবর জনজাতির জন্য। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কৃষি-সহ নানা ক্ষেত্রে শবররা ধীরে ধীরে মূল স্রোতে ফিরছেন। স্কুল-কলেজেও যাচ্ছেন অনেকে। তবে একথা ঠিক শিক্ষাক্ষেত্রে সার্বিকভাবে তাঁরা শতাংশের হিসেবেও আসেন না।

রমনিতা এবার সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে চান। শিক্ষিকা হতে চান তিনি। আর তারপর শবরদের উন্নতি করতে চান। তাঁদের মধ্যে শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতে চান রমনিতা। কারণ এখনও শবর সম্প্রদায় অনেক পিছিয়ে। বেশিরভাগই পড়াশোনা জানে না। তাই এই পিছিয়ে পড়া জনজাতিকে আধুনিকতার আস্বাদন করাতে চান রমনিতা। ফুলঝোরের ৩৫ ঘর শবরদের মধ্যে অনেকে পড়াশোনা করছেন। খেড়িয়া-শবর জনজাতির মেয়ে রমনিতা, শকুন্তলা, ও বসুমতীর হাত ধরে শবর প্রজাতি এবার ‘চোর’ বদনাম ঝেড়ে ফেলে সম্মানের সঙ্গে মাথা উঁচু করে বাঁচার লড়াই শুরু করে দিয়েছেন। রমনিতা এখন পিছিয়ে পড়া জনজাতির মেয়েদের কাছে এক প্রেরণার নাম।

দীপক সাহা (পশ্চিমবঙ্গ)

এই সংবাদটি শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




raytahost-demo
© All rights reserved © 2019
ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: Jp Host BD