পাভেল আমান।।
ছোটবেলায় যে শিল্পীর গান শোনার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকতাম, যার দরদী গলায় ভেসে উঠতো সুরের জাদু, যার অনুপম গায়কীতে মুগ্ধ হতাম, যার প্রতিটা গান মনন কে নাড়া দিত, ঋদ্ধ করত, ভাবাত, চিন্তনের জগতে বুঁদ করত অর্থাৎ সুরের সম্পানে সম্মোহিত করে রাখত তিনি আর কেউ নন আমার আপনার সকলের সর্ব প্রিয়, সর্বজনীন,জনপ্রিয় কালজয়ী সংগীতশিল্পী মোহাম্মদ রফি। যার সংগীতে প্রত্যেকেই আচ্ছন্ন হয়ে থাকতো, যার গান এখনো আসমুদ্রহিমাচল বাসীকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছি সর্বোপরি একসূত্রে বেঁধেছে। তিনি প্রবাদপ্রতিম, সুরের রাজা, সঙ্গীত জগতের মহাগুরু, প্রবাদপ্রতিম শিল্পী মোহাম্মদ রফি। তাঁর গায়কী সত্তা, সাধনা, সুরের চর্চা ছিল ধরাছোঁয়ার বাইরে। ১৯২৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর তদানীন্তন ব্রিটিশ ভারতের পাঞ্জাব এলাকার অমৃতসর গ্রামের কাছাকাছি কোটলার সুলতান সিংয়ে জন্ম গ্রহণ করেন মহম্মদ রফি। তাঁর গায়কি সত্তা অনেকটা সহজাত। অর্থাৎ সংগীতের প্রতিভা নিয়েই গানের জগতে তাঁর আবির্ভাব। তারপর থেকেই শুরু হয়ে যায় সঙ্গীত সাধনা। প্রবাদে আছে যার মধ্যে প্রতিভা জন্মগত তাকে কি আর রোখা যায়। মোহাম্মদ রফির সেই বিরল প্রতিভার অধিকারী সংগীতশিল্পী। ভারতীয় তথা এই উপমহাদেশের সঙ্গীত ভুবনে তিনি হয়ে উঠেছিলেন মহামহিম, সুর সাধক ও সংগীতের অন্যতম অধীশ্বর।৪০ বছর কেটে গেল তিনি নেই। নেই তাঁর সময়ের অগণিত শ্রোতা–অনুরাগী, ভক্তকুল, সঙ্গীতপ্রেমী। যে দুটি প্রজন্মকে পাঁচ থেকে আটের দশকের শুরু পর্যন্ত সুরের নেশায় বুঁদ করে রেখেছিলেন তিনি, তারও পরে এসেছে নতুন জমানা। নতুন যুগের নতুন বিনোদনে তাঁরাও সাবালক হয়েছেন দু’দশক আগে। তবুও বদল হয়নি ভারতীয় সঙ্গীত শাহেনশার মুকুটটির উত্তরাধিকার। না–হলে মাত্র বছর পাঁচেক আগে সিএনএন–আইবিএন সমীক্ষায় কীভাবে উঠে আসে, এখনও এই উপমহাদেশে জনপ্রিয়তম গায়কটির আর কেউ নন মহম্মদ রফি ছাড়া? কীভাবেই–বা বিখ্যাত আন্তর্জাতিক এক বাণিজ্যিক সংস্থা ও স্টারডাস্ট পত্রিকা ঘোষণা করতে পারে— সহস্রাব্দের সেরা কণ্ঠশিল্পী হলেন মহম্মদ রফি?প্রয়াণের এত বছর পরেও রফির এমন জনপ্রিয়তা কপালে ভাঁজ ফেলে হাল আমলের সঙ্গীত শিল্পীদের। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই যাঁদের বহু শিরোপাধারী গানও হারিয়ে যায় স্মৃতির ডাস্টবিনে! দ্বিতীয় বার আর কেউ শোনার আগ্রহ প্রকাশ করে না, বিস্মৃতপ্রায় সেই সমস্ত জনপ্রিয় গানের ডালি ।অথচ রফি, মুকেশ, কিশোরদের গান শুনতে গিয়ে সেই প্রবীণ এমনকি নবীন শ্রোতাকুলও ভুলে যান সময়ের পাকদণ্ডী! তারা যেন খুঁজে পান অফুরন্ত ভালোলাগা, শাশ্বত জীবনের পরিপূর্ণতা। এমনই আবেদন, গ্রহণযোগ্যতা, সর্ব জনপ্রিয়তা এই সমস্ত শিল্পীদের কালোত্তীর্ণ সংগীতের।এমনই সুরের অধিকারী ছিলেন কিংবদন্তি শিল্পী মোহাম্মদ রফি।এই সেই কিংবদন্তিতুল্য সংগীতিশিল্পী মোহাম্মদ রফি, যাঁর সম্পর্কে সয়ং লতা মঙ্গেশকার বলেছিলেন, আগামী ১০০ বছরেও ভারতবর্ষে রফির মতো একজন কণ্ঠশিল্পীর জন্ম হবে না।কিশোর কুমার বলেছেন আমাদের যুগের সেরা কণ্ঠশিল্পী হচ্ছেন- রফি।রফি এতটাই জনপ্রিয় ছিলেন যে, শোনা যায়- ভারতে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত এক আসামীর রায় কার্যকর করার সময় তাকে জিজ্ঞেস করা হয়, শেষ ইচ্ছে কী। ওই ব্যক্তিটি তখন বলেছিল, মোহাম্মদ রফির ‘ও দুনিয়া কে রাখনেওয়ালে’ গানটি শুনে সে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে চায়!শুধু তাই নয়, রফির মৃত্যুর পর অনেক ভক্তও দিশাহীন হয়ে পড়েছিল, আত্মহত্যাও করেছিল কেউ কেউ। রাস্তায় রাস্তায় শোকাহত মানুষের ঢল নেমেছিল।এতেই বোঝা যায় রফি কত বড় মাফের শিল্পী ছিলেন। ভারতীয় সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে একসময় সমগ্র উপমহাদেশে কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব ছিলেন মহম্মদ রফি। প্রায় চল্লিশ বছর সময়কাল ধরে সঙ্গীত জগতে থাকাকালীন তিনি ছাব্বিশ হাজারেরও অধিক চলচ্চিত্রের গানে নেপথ্য গায়ক হিসেবে সম্পৃক্ত ছিলেন মোহাম্মদ রফি। সঙ্গীত কলায় অসামান্য অবদান রাখায় শ্রেষ্ঠ গায়ক হিসেবে জাতীয় পদক এবং ৬-বার ফিল্মফেয়ার পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন মোহাম্মদ রফি। তিনি বহুবিধ গানে অংশ নেয়ার বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। তন্মধ্যে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, দেশাত্মবোধক গান, বিরহ-বিচ্ছেদ, উচ্চ মার্গের প্রেম-ভালবাসা, কাওয়ালী, ভজন, গজল-সহ বিভিন্ন গোত্রের গানে দক্ষতা ও পারদর্শীতা দেখিয়েছেন সমানভাবে। বিশেষ করে হিন্দী এবং উর্দু ভাষায় সমান দক্ষতা থাকায় তার গানগুলোতে বৈচিত্র্যতা এসেছে সমধিক। অবশেষে এই মহান কিংবদন্তি শিল্পীর জীবনে সবাইকে অবাক করে দিয়ে নেমে এলো চরম পরিণতি।৩১ জুলাই, ১৯৮০ইং তারিখ বৃহস্পতিবার রাত ১০:৫০ ঘটিকায় উপমহাদেশের অমর সঙ্গীতকার মোহাম্মদ রফি’র মহাপ্রয়াণ ঘটে। আকস্মিকভাবে মাইওকার্ডিয়াল ইনফার্কশন বা হৃদজনিত সমস্যায় ভুগে যখন রফি’র মৃত্যু ঘটে, তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ৫৬। অথচ এই বয়সে তাঁর সঙ্গীত ভুবন ছেড়ে চিরবিদায় অনেকে মনে প্রানে মানতে পারেননি। তবুও যেতে হবে এটাই প্রকৃতির বিধান ।সম্মুখে পড়েছিল এখনো বিস্তৃত সুরের জগত।শিল্পী মোহাম্মদ রফি সঙ্গীতের জগতে নিজেকে বারবার গড়েছেন,ভেঙেছেন। তিনি তার কণ্ঠ-সুরের মায়াবী গানের মাধ্যমে মানুষের মনগভীর রাজ্যের ভাবাবোধকে জাগিয়ে তুলতেন। তার ভক্তরা মনে করেন, তিনি একজন কণ্ঠের যাদুকর। তাই এই উপমহাদেশের সঙ্গীত জগতের জন্য শিল্পী মোহাম্মদ রফি সবসময় নতুন এবং প্রাসঙ্গিক। তার মতো মহৎ শিল্পীরা বারবার আসে না, ক্ষণে ক্ষণে আসে এ পৃথিবীর তরে। ভারতীয় সংগীত জগতে তিনি একজন নক্ষত্র হয়ে থেকে গেছেন। তাঁর গানের মূর্ছনায় প্রজন্মের পর প্রজন্ম মোহিত হয়ে রয়েছে। প্রয়াণ দিবসে মহান শিল্পীর প্রতি রইল শ্রদ্ধা ভক্তি ভালোবাসা।
পাভেল আমান- হরিহর পাড়া- মুর্শিদাবাদ
Leave a Reply