পর্ব ১:
পুরনো সেই পথের ধারে
শান্তা মারিয়া।।
বেগম বাজার। রাস্তাটা চলে গেছে সোজা। মৌলভিবাজার থেকে চকবাজারের মোড়ের দিকে। সরু রাস্তা। ছায়াচ্ছন্ন। প্রখর রোদের দিনগুলোতেও এই রাস্তার ছায়াময় ভাবটা পুরোপুরি কাটে না। এখনও চোখ বন্ধ করলে আমি ফিরে যাই সেই পথটিতে। দেখতে পাই রাস্তার দু’পাশে সারি সারি পুরনো ভবন। বেশিরভাগই দোতলা, তিনতলা। রাস্তার দিকে মুখকরা খুব পুরনো বারান্দা। শিক লাগানো জানালা। খড়খড়ি একটু ফাঁক করে হয়তো সেখান থেকে পৃথিবীটা দেখছেন বনেদী বাড়ির কোন কুলবধু। এ আমার অতি প্রিয় আজন্ম পরিচিত পুরনো ঢাকা।
চীনের কুনমিং শহরের সবুজ পাহাড়ের এক ঘরের জানালা দিয়ে চোখে পড়ে নীল আকাশ। সেই একই আকাশ যেমনটি দেখেছিলাম আমার শৈশবে পুরনো ঢাকায়। আমি ফিরে যাই আমার শৈশবে, কিশোরবেলায়।
ঢাকা। জন্মশহর। শৈশব, শিক্ষা, বেড়ে ওঠা সব কিছুই এই প্রিয় শহরটিতে। ঢাকাকে বলা হয় চারশ বছরের পুরনো। এই কথাটিতে আমার ঘোরতর আপত্তি। চারশ বছর হলো মোগল সুবাদার ইসলাম খাঁয়ের আগমন ও ঢাকাকে সুবে বাংলার রাজধানী হিসেবে গড়ে তোলার ইতিহাস। জনপদ হিসেবে ঢাকা এর চেয়ে অনেক প্রাচীন।
প্রাচীনকালেই ঢাকার কিছু অংশে জনবসতি ছিল। ঢাকা তখন প্রায় দ্বীপের মতো। চারদিকেই নদী। প্রাচীন জনপদ বিক্রমপুরের খুব কাছে।
ঢাকার সঙ্গে জড়িয়ে আছে সেন রাজবংশের রাজা বল্লাল সেনের নাম। রাজা আদিসুর তার রানীকে নির্বাসন দিয়েছিলেন বুড়িগঙ্গা নদীর তীরের জঙ্গলে। সেই রানীর গর্ভেই বল্লাল সেনের জন্ম। সে সময় দেবী দুর্গাই এক বিশেষ রূপে শিশু রাজপুত্রকে রক্ষা করেন শ্বাপদ সংকুল অরণ্যের বিপদ থেকে। বল্লাল সেন রাজা হয়ে এই জঙ্গলে দেবীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। সেই দেবী হলেন ঢাকেশ্বরী। ঢাকেশ্বরী দেবীর নাম অনুসারেই এই জনপদের নাম ঢাকা।
আবার অন্য কাহিনীতে রয়েছে এই অঞ্চলের প্রাচীন রাজ্য ছিল ডাবেকা। সেই ডাবেকা রাজ্যের একটি কেল্লা ছিল ফতুল্লার কাছে। সেই ডাবেকা রাজ্য ও কেল্লা থেকেই ঢাকা নামের উদ্ভব।
চারিদিকের নদী বেষ্ঠিত ঢাকার উচুঁ অঞ্চলে ছিল সোনার গাঁও বা বিক্রমপুর রাজ্যের টহলচৌকি যার আরেক নাম ঢাক্কা। সেই থেকেও ঢাকা নামের সৃষ্টি হতে পারে। আর ঢাকের আওয়াজ থেকে ঢাকা নামের উৎপত্তির কথাও জানা যায়। সে যাই হোক। এর কোনটাই প্রমাণিত নয়। তবে এটুকু নিশ্চিত যে প্রাচীন কাল থেকেই এ অঞ্চলে ছোট একটি জনপদ ছিল যা হয়তো আধা গ্রামীণ আধা শহর হিসেবে গড়ে উঠেছিল। সুলতানি আমলেও এখানে মসজিদ ও অন্যান্য স্থাপনা ছিল। পেশাজীবী কিছু মানুষ এখানে বাস করত। মূলত বুড়িগঙ্গার তীরেই তাদের বসবাস ছিল। হাটেরও অস্তিত্ব ছিল। তবে খুব জমজমাট শহর ছিল না একথা হয়তো বলা যায়।
১৬১০ সালে মোগল সুবেদার ইসলাম খাঁ ঢাকায় আসেন। নতুনভাবে নগর গড়ে তোলেন তিনি। মোগল আমলে গড়ে ওঠে পুরনো ঢাকার অধিকাংশ এলাকা। সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকে ঢাকা ছিল বিশ্বের অন্যতম সেরা শহর। ঢাকার বাসিন্দাদের শান শওকত ও জৌলুস ছিল দিল্লির বাদশাহী ঐতিহ্যের মতোই। মোগল আমলে সুবে বাংলা ছিল সাম্রাজ্যের সোনার ডিম পাড়া হাঁস। তাই এ অঞ্চলের মানুষের বিশেষ করে ঢাকাবাসীরও গড়ে উঠেছিল শাহী মেজাজ। নবাবী আমলের শেষ দিকে এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনে ঢাকার রোশনাই কমলেও টিকে ছিল। আমার শৈশবে দেখা পুরনো ঢাকায় ছিল মোগল ও নবাবী আমলের আমেজ। পুরনো ঢাকার খাবার দাবার, পোশাক, উৎসব অনুষ্ঠানের জাঁকজমক, পাড়া, মহল্লার জীবন যাপন ও সম্পর্কে ছিল মোগল আভিজাত্যের ঝলক।
অন্যদিকে বিংশ শতকে নতুনভাবে গড়ে উঠতে থাকে ঢাকার রমনা ও অন্যান্য নতুন অঞ্চল। পাকিস্তান আমলের প্রথম ও শেষদিকে ধানমন্ডি ও গুলশান হয়ে উঠতে থাকে নতুন পরিকল্পিত অভিজাত এলাকা। নতুন ঢাকার বিকাশের মূল চালিকা শক্তি ইংরেজ আমলে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা।
১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা হয়। আমার দাদা জ্ঞানতাপস ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহ মহোমহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর আমন্ত্রণে শিক্ষক হিসেবে ১৯২১ সালেই যোগদান করেন। পশ্চিমবঙ্গের বশিরহাট থেকে তিনি চলে আসেন বল্লাল সেন, পাঠান, মোগলের স্মৃতিবাহী এই সুপ্রাচীন জনপদে। তিনি এখানে এসেছিলেন চাকরি করতে। কিন্তু ধীরে ধীরে এই শহরের প্রেমে পড়ে যান। এখানেই গড়ে ওঠে তার আবাস। প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্ধারিত ভবনে ক্যাম্পাস এলাকাতে বাস করতেন তিনি।
শহীদুল্লাহ পরিবারের সঙ্গে ঢাকার সম্পর্ক গত একশ বছরের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং রমনা অঞ্চল তখন প্রায় বিরানভূমি। বর্তমান ঢাকা মেডিকেল কলেজের গেট হাউজে থাকতেন শহীদুল্লাহ পরিবার। তার সন্তানদের কয়েকজনের জন্মও এখানে। রমনার কালীবাড়ি, কার্জন হল, বর্ধমান হাউজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বসবাসের জন্য কয়েকটি বাংলো, ঢাকা মেডিকেল কলেজ এবং কয়েকটি ভবন ছাড়া পুরো এলাকা জনবিরল। আশপাশে শিয়ালের আনাগোনা ছিল। এরই মধ্যে ছিল ঢাকার নবাবদের নাচঘর(যেটি পরে হয় মধুর ক্যান্টিন), শাহবাগের কয়েকটি বাড়ি, রমনায় রেসকোর্স বা ঘোড়দৌড়ের মাঠ(বর্তমান সোহরাওয়ার্দি উদ্যান)। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে ছিলেন শহীদুল্লাহর মতো বহু ভাষাবিদ, সত্যেন বোসের মতো বিজ্ঞানী।
আমার বাবা মুহম্মদ তকীয়ূল্লাহর জন্ম ১৯২৬ সালে। সেসময় শহীদুল্লাহ ছিলেন প্যারিসের সোরবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণায় নিমগ্ন। তিনি চর্যাপদের উপর গবেষণা করেন। তার গবেষণাপত্রের বিষয় ছিল চর্যাপদের বৌদ্ধগান ও দোহা(Buddhist Mystic song)। শহীদুল্লাহ বিদেশে তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টার ছেড়ে দিতে হয়েছিল। শহীদুল্লাহ পরিবার তখন লালবাগ এলাকায় হরিমোহন শীল স্ট্রিটের একটি ভাড়া বাড়িতে বাস করতেন। ১৯২৮ সালে দেশে ফেরার পর আবার সপরিবারে শহীদুল্রাহ চলে আসেন বিশ্বদ্যিালয়ের গেট হাউজে।
Leave a Reply