শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৮:৫৮ অপরাহ্ন

শিরোনাম :
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ (কসবা-আখাউড়া) আসনে আইন মন্ত্রী আনিসুল হক বে-সরকারি ভাবে নির্বাচিত কসবায় ভোট দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ১ আহত-৪ কসবায় এলজিইডি’র শ্রেষ্ঠ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠান আগরতলায় স্রোত আয়োজিত লোকসংস্কৃতি উৎসব কসবা প্রেসক্লাব সভাপতি’র উপর হামলার প্রতিবাদে মানবন্ধন ও প্রতিবাদ সভা কসবায় চকচন্দ্রপুর হাফেজিয়া মাদ্রাসার বার্ষিক ফলাফল ঘোষণা, পুরস্কার বিতরণ ও ছবক প্রদান শ্রী অরবিন্দ কলেজের প্রথম নবীনবরণ অনুষ্ঠান আজ বছরের দীর্ঘতম রাত, আকাশে থাকবে চাঁদ বিএনপি-জামাত বিদেশীদের সাথে আঁতাত করেছে-কসবায় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ১৩ দিনের জন্য ভোটের মাঠে নামছে সশস্ত্র বাহিনী
নারীর ক্ষমতায়নে ড.আম্বেদকরের ভূমিকা

নারীর ক্ষমতায়নে ড.আম্বেদকরের ভূমিকা

লিপিকা বিশ্বাস সাহা

ভারতবর্ষের নারীবাদীদের তালিকা তৈরি করতে গেলে আমরা সাধারণত রামজী মালোজী শকপাল ও ভীমাবাই-এর সন্তান ভারতরত্ন বাবা সাহেব ডঃ ভীমরাও রামজী আম্বেদকরকে বিস্মরণের তালিকাতে রাখি।এব্যাপারে তাঁর অবদানকে আমরা কার্যত অচ্ছুত ও সীমাবদ্ধ করে রেখেছি দলিত নেতা হিসেবে তকমা দিয়ে। ভারতবর্ষে নারীর ক্ষমতায়নে আম্বেদকরের মহান অবদানকে কোনো এক বিচিত্র কারণে অস্পৃশ্য করে সম্পূর্ণ ভাবে অবজ্ঞাভরে লুকানো হয়েছে। একজন নারী শিক্ষার্থী ও পরবর্তীতে আইনের ছাত্রী হিসেবে সংবিধান পড়ার আগে পর্যন্ত প্রচলিত পাঠ্যক্রমে এ সম্পর্কে তাঁর কার্যকলাপ বর্ণিত এক লাইনও পড়ার সৌভাগ্য হয়নি আমার বা হয় না আমাদের ।

হলফ করে বলা যায় খুব নাগরিকেরই ধারণা আছে যে আজ জাতি,ধর্ম ,বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে সবার তরে সংবিধানের শীলমোহরের তলায় যে সাম্যের অধিকার সংরক্ষিত হচ্ছে তার জন্য আমরা এই যুগপুরুষের কাছেই ঋণী। তাই শুধুমাত্র ‘দলিত নেতা’ বা ‘সংবিধানের জনক’ হিসেবে বিবেচনা করে এই দিকপাল অর্থনীতিবিদ ,রাজনীতিবিদ ও সর্বপরি এক মহান সমাজ সংস্কারকের মূল্যায়ন করা একজাতীয় ধৃষ্টতা ও অপরাধ । আর এধরণের দৃষ্টিভঙ্গি ভারতীয় সমাজব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনে ডঃ আম্বেদকরের অবদান, কার্যক্রম ও চিন্তাধারার প্রতি শুধুমাত্র অহিতকর তাই নয় ,নারীবাদী আন্দোলনের মৌলিক উপলব্ধির ক্ষেত্রেও যথাযথ মর্যাদাকর নয়। নারী সমাজের উন্নয়নের নিরিখেই আমি সমাজের অগ্রগতির পরিমাপ করি বলেছিলেন ডঃ ভীমরাও রামাজী আম্বেদকর।

বৈদিক যুগের আদি পর্বে নারীরা জীবনের সকল ক্ষেত্রেই পুরুষের সঙ্গে সমানাধিকার ভোগ করলেও কালের আবর্তনে আর্যদের মনুবাদী পুরোহিততন্ত্রের রক্ষণশীলতায় নারীজাতি দাসী-বাদী, ভোগের বস্তুতে পরিনত হয়েছিল। আসলে ঈশ্বরের নামে, ধর্মের নামে নারীকেই বলির যূপকাষ্ঠে চড়িয়ে জাতীভেদ দ্বারা, অনুলোম বিবাহের অনুমোদন ও প্রতিলোম বিবাহ নিষিদ্ধকরণের মাধ্যমে ,পুরুষকে বহুবিবাহের অনুমতি দিয়ে এবং নারীকে রক্ষনাবেক্ষনের নামে স্ত্রীজাতির যৌনতাকে নিয়ন্ত্রণ ও কব্জা করা হয়েছে যুগযুগান্ত ধরে। এদেশে ধর্মীয় শাস্ত্রগ্রন্থ গুলিতে ও ধর্মীয় বিধানে “নারী নরকের দ্বার। চণ্ডাল, শব, ব্রহ্মহত্যাকারী, ঋতুমতী নারী, নবপ্রসূতা সম অপবিত্রা।’ পুরুষের ইচ্ছাধীন নারীর জন্য শাস্ত্রের অমোঘ বিধান হল – ‘একজন নারী কখনই কোন পরিস্থিতিতে স্বাধীন ভাবে বাস করতে পারবে না।নারী বাল্যকালে পিতার অধীন , যৌবনে স্ত্রী রূপে স্বামীর অধীন, স্বামী প্রেতলোক প্রাপ্ত হলে পুত্রের অধীনে থাকবেন, পুত্র না থাকলে স্বামীর সপিণ্ডের অধীনে থাকবেন। কারণ এদের থেকে পৃথক হলে পিতৃকূল ও পতিকূল- উভয় কূলকেই তিনি কলঙ্কিত করবেন।'(মনুস্মৃতি, ৫/ ১৪৭,১৪৮,১৪৯)

গোড়া বর্ণবাদী ভারতে গৃহপালিত পশুর মতো গৃহকোণে, পর্দার আড়ালে গৃহদাসী হয়ে কঠোর সামাজিক ব্যবস্থার শিকার হয়ে নারীর জীবনকাল কাটাত। ‘স্বামীর চরিত্র যেরূপই হোক স্বামী ভিন্ন স্ত্রীজাতির পৃথক উপাস্য নেই ,পতির পুণ্যেই সতীর পুণ্য – অক্ষয় স্বর্গবাস ‘এই মোহ মেশানো বাক্যের আবেগে নারীকে মোহাবিষ্ট করে বোঝানো হয়েছিল এতেই নারীর মঙ্গল , অন্যথায় কুষ্ঠ প্রভৃতি বিভিন্ন পাপরোগে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা। এই কুটিলতা ও ছলনার ভুল ভুলাইয়াতে পড়ে নারী তার অস্তিত্বটাই হারিয়ে ফেলেছিল। ভুলতে বসেছিল মানুষ রূপে সমাজে তাঁরও কিছু মৌলিক মানবিক অধিকার আছে।

কুসংস্কারাচ্ছন্ন ভারতবর্ষে ধর্মের ধ্বজা তলে সতীদাহ প্রথার নামে স্বেচ্ছায় সহ মরণের আড়ালে চলত নারীহত্যা ।বাল্যবিধবার জীবন ছিলো মৃত্যুর চেয়েও ভয়ঙ্কর।কঠোর ব্রহ্মচর্য পালনের মাধ্যমে দেহ সৌন্দর্য নষ্ট করে স্বর্গ লাভ করার কথা শাস্ত্রে বলা হলেও কোনো কোনো নারীর জীবন কেটেছে ধর্মস্থানে ধর্মদাসী বা যৌনদাসী হয়ে। আবার কারো কারো জীবন কাটতো কোনো বৃদ্ধ কুলীন পুরুষের বহু পত্নীর নামমাত্র একজন হয়ে। বন্ধ্যা বা রুগ্না স্ত্রীকে ত্যাগের বিধান শাস্ত্র সম্মত, কিন্তু পুত্র যেহেতু স্বর্গের দ্বার ও নরক হতে উত্তরণের পথ তাই উর্বরতাহীনতার কারণে পুত্র উৎপাদনে অক্ষম পুরুষের তার স্ত্রীকে শস্যক্ষেত্রের ন্যায় ব্যবহার করে ফসল স্বরূপ ক্ষেত্রজপুত্রের মালিকানা লাভ ধর্মসিদ্ধ। অর্থাৎ নারী সন্তান জন্ম দেওয়ার যন্ত্র মাত্র। তাঁকে যেরূপ ইচ্ছা ব্যবহার করে ছিন্ন বস্ত্রের মতো পরিত্যাগ করা যায়। শাস্ত্রোক্ত বিধি অনুযায়ী শিক্ষাবঞ্চিত স্ত্রীজাতির ধর্মাচরণ মন্ত্রোচ্চারণ ,পিতার সম্পত্তিতে অধিকার ছিল না। স্বাধীনতা, আত্মমর্যাদা, ইত্যাদি শব্দগুলি থেকে নারী ছিল বহু যোজন দূরে।

শাস্ত্রীয় বিধিনিষেধ ও ভিত্তিহীন ঐতিহ্যের নামে ভারতীয় নারীদের উপর অনুশাসনের বোঝা নিশ্চিত ভাবেই নারীকে সম্মানিত করেনি বরং নারীর আত্মমর্যাদা, আত্মপরিচয় ও ব্যক্তিত্বের বিকাশকে শাসক ও পুরোহিততান্ত্রিক সংস্কারের বেড়াজাল অবরুদ্ধ করেছে , করেছে নারীর মৌলিক মানবিক অধিকার। আসলে মানবিক মূল্যবোধের সম্পূর্ণ বিপরীত ধর্মীয় গোঁড়ামি, প্রকৃতপক্ষে শোষণ- বঞ্চনার এক মারণাস্ত্র।

আম্বেদকর হলেন সেই দেবদূত যিনি অপমানিত, অবদমিত শৃঙ্খলিত নারী জীবনের তমসাকে স্বাধীন ভারতে আইনের দ্বারা দূর করেছেন। দেশ স্বাধীন হবার আগে থেকেই মনুবাদী শাষনব্যবস্থার অচলায়তন পর্বতগুলো ভাঙতে শুরু করেছিলেন। প্রকাশ্যে মনুস্মৃতি পুড়িয়ে পিতৃতান্ত্রিক ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রতিবাদ করেন( ২৭ডিসেম্বর ,১৯২৭)।
কাস্ট ইন ইন্ডিয়া (১৯১৭) বই প্রকাশ,মূখনায়ক পত্রিকা (১৯২০)ও বহিস্কৃত ভারত পত্রিকা(১৯২৭) প্রকাশনার মাধ্যমে ‘জাতের নামে বজ্জাতি ‘ -র জগদ্দল পাথরগুলো অপসারণে তাঁর সুচিন্তিত ও সুদূরপ্রসারী চিন্তাধারার প্রকাশ করতে থাকেন।নারীর সম্পত্তির উপর অধিকার ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে তাঁর অনলস প্রয়াস ততকালীন বিশ্বের সনামধন্য নারীবাদীদেরও উৎসাহিত করেছিল। ১৯১৮সালে ভোটদানের অধিকার প্রসঙ্গে তিনই সর্বপ্রথম ভারতীয় নারীর রাজনীতিতে অংশগ্রহণ ,বিষন্ন শ্রেণীর ভোট দানের অধিকার ,সংরক্ষণ এবং পৃথক মনোনয়ন এলাকার দাবি তোলেন। এইসময়ই নারীবাদী আনন্দের ফলস্বরূপ ব্রিটেন (১৯১৮)ও আমেরিকার (১৯২০)নারীরা ভোট দানের অধিকার লাভ করেন। সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি কতটা দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ও সঠিক ছিলেন তা আজ আমরা বুঝতে পারছি।

নারী শিক্ষা ,সুরক্ষা , ধর্মীয় ও সামাজিক সম অধিকার সামনে রেখে নারীদের আত্মমর্যাদা রক্ষা ও বিকাশে বাবা সাহেব আম্বেদকর ভারতবর্ষে নারী আন্দোলনের এক যুগান্তকারী অধ্যায়ের সূচনা করেন। তাঁর অনুপ্রেরণায় গঠিত মহিলা সংঘ মহারাষ্ট্রের নাসিকে কালারাম মন্দিরে নারী ও দলিত -অচ্ছুতের প্রবেশের অধিকার নিয়ে সত্যাগ্রহ আন্দোলন করেন (২মার্চ ,১৯৩০)। মূলত সেই দিন থেকেই ভারতবর্ষের সমস্ত নাগরিকের ‘সম অধিকার’ অর্জনের লড়াই শুরু হয়।

ডঃ আম্বেদকর অসামান্য উক্তি–” যে সমাজে নারী-পুরুষের অধিকার ও মর্যাদা সমান, সেই সমাজ দ্রূত উন্নতির শিখরে আরোহণ করে।’ পরাধীন ভারতে বোম্বে বিধান পরিষদের সদস্য থাকা কালীন আম্বেদকরের সবচেয়ে মহান অবদান হলো শ্রমজীবী মহিলা কর্মীদের মাতৃত্বকালীন ছুটির জন্য ‘মেটারনিটি বেনিফিট বিল (১৯২৮) চালু করা। তিনিই সর্বপ্রথম এই ব্যবস্থা চালু করার প্রস্তাবনা করেন ও দৃঢ়তার সাথে আওয়াজ তোলেন সমগ্র ভারতবর্ষে এই বিল চালু করা হোক এবং সুপারিশ করেন, শুধুমাত্র ভারতে সীমাবদ্ধ না রেখে বিশ্বজুড়ে প্রতিটি দেশে এই বিলের নীতি গৃহীত হোক। বর্তমান কালে যে সকল চাকুরীরতা মহিলারা মাতৃত্বকালীন ছুটি ভোগ করেন, তাঁরা কি ডঃ আম্বেদকরের এই অবদানের কথা জানেন? ঠিক কতটা জানেন তার বহিঃপ্রকাশ দেখিনি কোথাও তাঁর জন্মদিনে বা অমৃতলোক প্রাপ্তির দিনে ।বোম্বে বিধান পরিষদের সদস্য থাকা কালেই তিনি প্রস্তাবনা করেন ,জন্মনিয়ন্ত্রণ সুবিধা নারীর প্রাপ্য অধিকার এবং প্রজননে নারীর পছন্দ ,নিয়ন্ত্রণ, অধিকার ও স্বাধীনতার পক্ষে মত দেন ( ১৯৩৮) ।পরবর্তীতে ভাইসরয় কার্যনির্বাহী কমিটির আইনমন্ত্রী হিসেবে (১৯৪২-৪৬) তিনিই ভারতবর্ষের বুকে প্রথম, বঞ্চিত নারী শ্রমিকদের জন্য লিঙ্গ বৈষম্য রদ করে ‘ সম কাজে সম বেতনের ব্যবস্থা’ চালু করেন। মহিলা কর্মচারী কল্যাণ তহবিল ,মহিলা ও শিশুশ্রমিক নিরাপত্তা আইন তাঁরই মস্তিষ্ক প্রসূত ফল। নারীপুরুষ নির্বিশেষে কর্মচারী রাজ্য বিমা ,মেডিকেল লিভ ,লিভ বেনিফিট , সময়মত বেতন সীমা সংশোধন ,নূন্যতম মজুরি আইন তাঁর সময়েই চালু হয়।

অর্থনীতিতে ডক্টরেট অর্জনকারী প্রথম ভারতীয় ,ব্যাঙ্ক ব্যবস্থা ও অর্থনীতির মেরুদণ্ড রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার রূপরেখা ও নীতি নির্দেশিকা নির্ধারক ডঃ আম্বেদকর স্বাধীন ভারতবর্ষের প্রথম আইনমন্ত্রী হিসেবে হিন্দু বিবাহ আইন , বহুবিবাহ বিলোপের মাধ্যমে একগামিতার আইনিকরণ,বাল্যবিবাহ রদ, বিবাহ বিচ্ছেদ আইন, নারীর সন্তান দত্তক নেবার ও সন্তানের অভিভাবকত্ব অধিকার ,সর্বপরি সম্পত্তির উপর নারীর অধিকার ও উত্তরাধিকারের উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে আইনত নারীকে সমান পঙক্তিতে বসাতে হিন্দু কোড বিল (১৯৪৮)উপস্থাপন করেন।

দুর্ভাগ্যবশত গোঁড়াপন্থী রাজনৈতিক নেতারা এই বিলকে ‘আত্মঘাতী মূর্খতা’ ,’বিপদে হিন্দুধর্ম ‘ হিসেবে চিহ্নিত করে প্রবল বিরোধিতা করেন। দীর্ঘ তিনবছর যাবৎ সংসদে বিতর্ক এবং বাইরে বর্ণবাদীদের বিক্ষোভের জন্য স্বাধীন দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের(১৯৫১, ২৫অক্টোবর ) প্রাক্কালে প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু ‘অতিরিক্ত বিরোধ’ কারণ দেখিয়ে এই ঐতিহাসিক বিলটির বাতিল ঘোষণা করেন। দেশের সংখ্যা গরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর সমাজ সংশোধনের মাধ্যমে নারীদের অধিকার আদায়ে ভারতীয় নেতৃবৃন্দের এমন অনীহা দেখে ব্যথিত ডঃ আম্বেদকর মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করেন। শুধু মাত্র নারীদের ক্ষমতায়নের জন্য এমন আত্মত্যাগ পৃথিবীর ইতিহাসে এক অতিবিরলতম ঘটনা।

হিন্দু কোড বিল গৃহীত ভারতীয় সংবিধানের রচয়িতা হিসেবে তিনি জাতি ধর্ম নির্বিশেষে নারীর কল্যাণ ও সামাজিক অধিকারকে সাংবিধানিক ভাবে কার্যকর তুলতে এককভাবেই পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার চক্রব্যূহ ভেদ করেছিলেন।যা আসলে ভারতীয় নারীর আইনত ভাবে পূর্ণ মানবী হয়ে ওঠার শক্তিশালী প্রথম পদক্ষেপ। লিঙ্গ বৈষম্য দূর ,আইনগত ভাবে সমান সুরক্ষা,চাকরিতে সমান সুযোগ, সমবেতন ও মাতৃত্বকালীন ছুটির অধিকার ,বিনা পারিশ্রমিকে কাজে নিয়োগ এবং জোর করে অমর্যাদাকর পেশায় মেয়েদের ব্যবহার করা সংবিধান অনুসারে দণ্ডনীয় অপরাধ ঘোষণার মাধ্যমে নারীর সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা হয়। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আঙিনায় নারীদের পর্যাপ্ত ভাগীদারীর জন্য পঞ্চায়েত ও পৌরসভায় মহিলাদের জন্য আসন সংরক্ষণ ,নারী শিক্ষার জন্য স্বতন্ত্র কমিশন গঠন ,আলাদা বিদ্যালয় ও কলেজ গঠন, মহিলা শিক্ষিকা নিয়োগ, আবাসিক শিক্ষা ব্যবস্থা, ছাত্রী নিবাস, বিদ্যালয়ে যাতায়াতের সুবিধা তৈরি, বিনামূল্যে টিপিন, মেয়েদের উপযুক্ত পাঠ্যক্রম, বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক ,বৃত্তিমূলক শিক্ষা ইত্যাদি সুযোগ প্রদানে সাংবিধানিক ভাবে রাষ্ট্র বাধ্য থাকবে ।

‘একনিষ্ঠ ও সর্বোত্তম সামাজিক নথি’-সংবিধানের মাধ্যমে তিনি সামাজিক ন্যায়বিচারের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন এবং দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করতেন লিঙ্গ সমতা ছাড়া সামাজিক ন্যায়বিচার কখনোই হতে পারে না।তাই শত বাধা, বিরোধীতা সত্ত্বেও সংববিধানের মাধ্যমে নারী তথা প্রতিটি নাগরিককে ‘সমতা’ নামক যে রক্ষা কবোজ তিনি দিয়ে গেছেন তার সঠিক প্রয়োগে নারী জাতিরও দাসত্ব বিলোপ হবে।
কিন্তু বড়ো দুঃখের বিষয় দেশের অগ্রগতির পথিক, নিরলস যোদ্ধা হিসেবে যেরূপে যতবার পণ্ডিত নেহেরু বা জাতীর জনক মহাত্মা গান্ধীর নাম উচ্চারিত হয় সেরূপ ভাবে আধুনিক ভারতের জনক আম্বেদকরের নাম উচ্চারিত হয় না -এ এক রহস্যময় উপাখ্যান, যার ফলস্বরূপ সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র ভারতবর্ষ গড়ে ওঠার সঠিক ইতিহাস প্রকাশ পায় না।তবে আশার কথা ভারতবর্ষের মাটিতে ভারতীয় সংবিধান নামক যে বোধিবৃক্ষ এই ‘শ্রেষ্ঠ ভারতীয় ‘রোপণ করে গেছেন তাঁর ফল আমরা সকলেই ‘সম নাগরিক ‘হিসেবে ভোগ করছি এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মও ভোগ করবে ।যদিও অনেক পথ এখনও বাকি ।

সন্দেহ নেই আইনত নারীর মর্যাদা উন্নতি হয়েছে কিন্তু নারীর বন্ধনমুক্তিতে সরকার ও নারীর নিজের দিক থেকেই একটি স্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি থাকা একান্তভাবে আবশ্যক। আজ ভারতীয় নারী তাঁদের বুদ্ধিমত্তা, পারদর্শিতা, কর্মপটুতা, বিচক্ষণতা,পরিশ্রম ও সর্বপরি আন্তরিকতা দিয়ে জগতের বিভিন্ন ক্ষেত্রে,বিভিন্ন পেশায় শ্রেষ্ঠতা লাভ করেছে ঠিকই কিন্তু নারীর ক্ষমতায়নে নিজের অধিকার বুঝে নিতে রাজনীততে অংশ গ্রহণ অত্যাবশ্যক । তবে ক্ষমতায় মানে এই নয় যে ,অন্যের উপর কর্তৃত্ব করতে ক্ষমতা অর্জন,প্রকৃত ক্ষমতায়ন হল সমাজে কার্যকরী পরিবর্তন আনতে কাজ করা। এই দেশে নারীর ক্ষমতায়নের কথা বললে পুরুষতন্ত্রবাদীরা নারী প্রধানমন্ত্রী, নারী রাষ্ট্রপতি,নারী বিরোধীদলীয় নেতা, নারী স্পিকার, নারী মুখ্যমন্ত্রী ,নারী রাজ্যপাল ,রাজ্যসভায় সংরক্ষিত আসন ইত্যাদি উদাহরণ দিয়ে আত্মতুষ্টির ঢেঁকুর তুলে আজও পাশ ফিরে ঘুমান।হতাশাব্যঞ্জক চালচিত্র হল ভারতীয় শাসকগোষ্ঠী ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত যেভাবেই হোক না কেন নারীর অধিকারের গুরুত্ব সম্পর্কে পর্যাপ্ত জনসচেতনতা গড়ে তোলেননি। তাই ধর্মীয় মৌলবাদের সুরসুরি পালক প্রতিনিয়ত সাধারণ নারীকে আবিষ্ট করে রাখে ,’রাজনীতি আর চাকরি করা নারীর ধর্ম নয়।’আর ফলস্বরূপ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বকলমে পুরুষতন্ত্র নারীর অধিকার ভোগ করে।তাই যে মেয়েটি টোটো চালায় বা মাছবাজারে মাছ বেচে বা খুরকাঁচি হাতে তোলে বা ট্রেড ইউনিয়নে দাঁড়ায় সে আসলে শুধু খবর হয়ে নারীর ক্ষমতায়নের শত যোজন দূরে বসে টিকে থাকার লড়াই জোয়াল কাঁধে একা লড়ে।আর এই টিকে থাকার লড়াই লড়তে গিয়ে নিশ্চিত আশ্রয় বাড়ি থেকে রাষ্ট্রের রাজপথ সব জায়গায় সে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে, পৈশাচিক হিংস্রতা আগুনে পুড়ে মাংসপিণ্ডে পরিণত হয়। আর রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সম্মানের বীজ বিপরীত লিঙ্গের মনে রোপণ না করে নির্মম পরিণতির ইতিহাস মোমবাতি মিছিলের আগুনে লেখে।

লিপিকা বিশ্বাস সাহা
পশ্চিমবঙ্গ

এই সংবাদটি শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




raytahost-demo
© All rights reserved © 2019
ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: Jp Host BD