সঙ্ঘমিত্রা ভট্টাচার্য্য।।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি
জননী সাহসিকা কবি সুফিয়া কামালের কয়েকটি উক্তির মর্মার্থকে হৃদয়ে ধারণ করে তাঁর ১১১ তম জন্মবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করছি।
০১.”তখনকার সময়টাতে শ্রেণীভেদ একটা বড়ো ব্যাপার ছিল। বড়োলোক, ছোটলোক, সম্ভ্রান্ত লোক, চাষী-কৃষক, কামার-কুমার ইত্যাদি সমাজে বিভিন্ন ধরনের বংশ ছিল এবং এইসব বংশে শ্রেণীবিভেদ ছিল। সেই শ্রেণীভেদ অনুসারে বলা যায়, তখন মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্তদের ঘরের মেয়েরা পড়ালেখা বেশি জানতো না। তারা বড়োজোর কুরআন শরিফ পড়া শিখতো। আর হয়তো বাবা-মায়ের কাছে দোয়া-দরুদ নামাজ পড়া শিখতো। এই ছিল তাদের শিক্ষা। স্কুল-কলেজের বালাই তো ছিলই না। তবে ধর্মীয় শাসনের একটি প্রক্রিয়া ছিল। সেটা ছেলে-মেয়ে সকলের ওপরই কার্যকর থাকতো।”
সেই সময়ের একজন মুসলিম মহিলা হিসেবে অবরোধের চাদরে জড়িয়ে সমাজের সংকীর্ণ মানসিকতা ও সীমিত পরিসর থেকে বের হয়ে নারীকে সাহসের সাথে এগিয়ে যেতে উৎসাহিত করতেই জননী সাহসিকার সাহসিকতার সাথে অসাধারণ বুদ্ধিবৃত্তিক সামাজিক সচেতনতামূলক দৃষ্টিভঙ্গির বহিঃপ্রকাশ বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।
০২. “আগে মেয়েরা ষোলআনা নির্ভরশীল ছিল পুরুষের ওপর। স্ত্রীকন্যার কি প্রয়োজন না প্রয়োজন তা স্বামী বা পিতাই নির্ধারণ করতেন। যেখানে পুরুষ মানুষটি এসব ব্যাপার তেমন মাথা ঘামাতো না সেখানে স্ত্রীকন্যা নীরবে কষ্ট সহ্য করতো এবং সেই পরিস্থিতিতেই নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতো। এখন আবার যে সব মেয়েদের রোজগার আছে- স্বামীরা তাদের রোজগার কেমন করে খরচ হবে তাও বলে দিতে চায়। আর টাকা পয়সার ব্যাপারে দেখা গেছে মেয়েরা নিজের টাকা যত খরচ করে স্বামীরা ততই হাত গুটোয়। পুরুষদের সম্পর্কে উক্তি আছে ‘তারা হাতে মারে, ভাতে মারে, দাঁতে মারে’ এই অবস্থায় একজন মানুষ সুখী কেমন করে হবে? আর মেয়েদের ক্ষেত্রে কত স্তরের দুঃখ যে আছে তার ঠিক নেই। তাই তুলনামূলকভাবে কাউকে কাউকে একটু বেশী সুখী মনে হয়। পর্দার যুগে কোন অবস্থাতেই মেয়েটি বাড়ি ছেড়ে পালাতে পারতো না- আজকাল পারে। মেয়েদের স্বামী পরিত্যাগ করার ঘটনাও বিরল নয়। আজকাল মেয়েদের স্বাধীনতা বেশী এবং সেই অনুপাতে নিশ্চয়ই সুখও বেশী।”
পর্দানশীলতার সময় ও পরবর্তীকালের সময়ে মেয়েদের তুলনামূলক চিত্রটির সাথে কবি সুফিয়া কামালের আধুনিক, মার্জিত ও সুবিবেচিত জ্ঞানের সবটুকুই অত্যন্ত মার্জিত ও স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে।
০৩.”আমার কাছে সবচেয়ে ভালো লাগে এই দেখে যে, মেয়েরা আগের তুলনায় এখন অনেক সাহসী হয়েছে। মেয়েরা এখন রাস্তায় বেরিয়ে অন্তত নিজেদের কথা বলতে শিখেছে। আমরা চেয়েছিলাম, মেয়েরা কথা বলতে শিখুক, সাহসী হয়ে উঠুক, নিজেদের অধিকার তারা বুঝতে পারুক। এটা এখন হয়েছে। এটা বড়ো আনন্দের।”
সামাজিক শৃংখলের বেড়াজাল থেকে বের হয়ে কিভাবে মুক্ত জীবন যাপনের পথে অকুতোভয় সৎসাহসী হয়ে নারী এগিয়ে যাবে অর্থাৎ সামগ্রিক নারীমুক্তির জন্য সাহসিকা জননীর আন্তরিক অনুভূতিরই বহিঃপ্রকাশ প্রাঞ্জল ভাষায় ফুটে উঠেছে।
০৪.”মেয়েরা স্বাধীনতা পেয়েছে। কিন্তু অনেকেই সেই স্বাধীনতার ব্যবহার সব সময় সঠিকভাবে করতে শেখেনি। অনেক সময় অপব্যবহার করছে। এটা আমার কাছে খুব খারাপ লাগে। এই যে মেয়েরা অপ্রয়োজনে বিদেশের ফ্যাশনের হুজুগে নিজেদের সংস্কৃতি বিরোধী কাপড় পরছে, ব্যবসায়ী মহল তাদেরকে ব্যবহার করছে নানাভাবে, মেয়েরা ভাবছে এটাই স্বাধীনতা। এটাই অপব্যবহার। মেয়েরা মডেলিং করুক, অভিনয় করুক, কিন্তু তা যেন মর্যাদা হারাবার মাধ্যম না হয়। অযথা অশালীন অভিনয়, যাত্রা, নাচগানের কোনো দরকার নেই। নারীদের যেন কোনো পণ্য না করা হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। বিজ্ঞাপনে মেয়েদের শরীর প্রদর্শন করিয়ে কোটি কোটি টাকা অর্জন করা হচ্ছে। এটা বন্ধ করতে হবে। পর্ণো ম্যাগাজিনের পণ্য হওয়া মেয়েদের বন্ধ করতে হবে।”
নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাসী প্রগতিশীল চিন্তাচেতনাকে নারী ধারণ করে এগুবে কিন্তু নারীকে যেন পন্য হিসেবে কুরুচিপূর্ণ কাজে লাগিয়ে অর্থ উপার্জনের নিয়ামক হিসাবে ব্যবহার না করা হয় সেরকম দুঃসাহসিক নেতৃত্বেও আঙ্গুল তুলে সতর্ক থাকার হুসিয়ারী দিতে ভ্রুক্ষেপহীনতাই জননী সাহসীকার উক্তি থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
০৫.”ইতিহাসে বার বার দেখা গেছে, মূঢ়তা এবং হিংস্রতা যখন সীমা অতিক্রম করেছে তখনই তার ধ্বংস অনিবার্য হয়ে উঠেছে- সে নিজেকেই নিজে ধ্বংস করেছে। হয়তো অনেক সুন্দর ও শুভকে এজন্যে আত্মহুতি দিতে হয়, কিন্তু ভয় এবং হতাশায় নিস্কৃতি কোথায়?——- আরও একটা কথা মানি, আমাদের দারিদ্র্য এবং হতাশার অন্যতম কারণ; জনসংখ্যার অনুপাতে আমাদের সম্পদের অভাব; মানুষের ক্ষুধায় এবং লোভে প্রকৃতি লুন্ঠিত, শূন্য হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু প্রতিকারের পথ একটাই : দুঃখের অন্ন সবাইকে একসাথে ভাগ করে খেতে হবে, তারপর মানুষ ও প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষার জন্যে বিজ্ঞানকে কাজে লাগাতে হবে। মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসাই সব সমস্যা দূর করতে সক্ষম।”
সাম্যের কবি, প্রেমের কবি কাজী নজরুলের মতোই সুফিয়া কামালও ভালোবাসা ও সাম্যকে প্রাধান্য দিয়ে সমাজ পরিবর্তনের কথা ভেবেছেন। সম্পদের অভাবের জন্য দারিদ্র ও হতাশার সৃষ্টি হয়। ক্ষুধা ও লোভকে সংযত করে ভাগাভাগি করে ক্ষুধা নিবারণ করে বিজ্ঞানের জ্ঞান দিয়ে জীবজগতের ভারসাম্য রক্ষায় কাজ করার প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। এসব উক্তি থেকে দার্শনিক সুফিয়া কামালের আধুনিক বিশ্বের সমাজিক বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তাভাবনায় কেবল নারী নয় নরনারীর সমন্বয়ে সমাজকে এগিয়ে নিতে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনাই যেনো সফলভাবে প্রতিভাত হয়েছে ।
০৬.”আমাদের যুগে আমরা যখন খেলেছি পুতুল খেলা /তোমরা এ যুগে সেই বয়সেই লেখাপড়া কর মেলা /আমরা যখন আকাশের তলে ওড়ায়েছি শুধু ঘুড়ি /তোমরা এখন কলের জাহাজ চালাও গগন জুড়ি।”
নারীর এগিয়ে চলার সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে স্বীকৃতিস্বরূপ জননী সাহসিকর কবিতার চরণগুলো বর্তমান সময়ের আরো অগ্রগতির প্রশংসা/ স্বীকৃতিও যেনো এ চরণগুলোরই অনুরণন!
শিক্ষা ও সংস্কৃতি সম্পাদক
ঢাকা মহানগর কমিটি
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ
Leave a Reply