শান্তশ্রী মজুমদার
ত্রিপুরা, ভারত
যাদের রক্তে একবার ভ্রমণের নেশা বাসা বাঁধে তারা নিজেদেরকে ঘরের চার দেয়ালে বন্দী রাখতে পারেনা। প্রতিনিয়ত সুযোগ খুঁজে বেড়ায়, প্রকৃতির সাথে মধুর মিলনের অপেক্ষায় প্রাণ আনচান করে। একটু খোলা হাওয়া, ঢেউ খেলানো জলরাশি, নীল পাহাড়, সবুজ বনানী —যখন দু হাত বাড়িয়ে আহ্বান করে তখন কোনো বাঁধাই আর বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় না।
———–
সবসময়ই যে দূরে বহুদূরে যেতে হবে এমন কোনো কথা নেই। নিজের শহর, নিজের রাজ্য, নিজের গ্রামেও লুকিয়ে থাকে এমন সব অনাবিল সৌন্দর্য যা,দেখার জন্য কল্পনার চোখ চাই, অনুধাবন করার জন্য চাই অনুভবী মন। প্রতিটি মানুষ কেই নিজের ভালোবাসা, ভালোলাগা, ভালোথাকার বিষয়টি কে প্রাধান্য দিতে হবে।নিজেই নিজেকে ভালো রাখতে পারি আমরা যদি আমাদের হৃদয়ের চাওয়াটাকে গুরুত্ব দিই।
———-
আজ আমি যে ভ্রমণের গল্প লিখছি, সেটা আমার শহরের ই গল্প। আমার শহর অর্থাৎ কৈলাসহর। পার্বত্য ত্রিপুরা র উত্তরে অবস্থিত মনু নদীর অববাহিকায় ঊনকোটি পাহাড়ের পাদদেশে বহু বহু যুগ আগে গড়ে উঠেছে এই জনপদ। দুই দিকেই
প্রতিবেশি রাষ্ট্র বাংলাদেশের সীমান্ত আর কাঁটাতারের বেড়া।
————–
এবার আমরা দল বেঁধে চলেছি কৈলাসহরের একদম উত্তর দিকে। আমাদের গন্তব্য হোল সেখানে প্রকৃতির কোলে সৃষ্ট একটা হ্রদ বা বিল। যা লোকমুখে খাওরা বিল নামে পরিচিত।
——–বিশাল এলাকা জুড়ে এই অপরূপ প্রাকৃতিক বিলটির মাঝখানে রয়েছে লালমাটির দ্বীপ। দূরে নীল পাহাড়। একটা স্নিগ্ধ সুন্দর নির্জন হ্রদকে কেন জানি বিল –বলে উচ্চারণ করতে খুব কষ্ট হচ্ছিলো। হ্রদটির নামকরণ কেন খাওরাবিল হোল এ নিয়ে বিস্তর আলোচনার পর আমরা এই সিদ্ধান্তে আসলাম যে, –মাঝি ভাইরা মাছধরার সময় নৌকোতে জল ঢুকলে খেইয়ে খেইযে জল ফেলতো। সেই থেকেই নাম হয়েছে খাওরা বিল। আমি যে দলের সাথে গিয়েছি, আমরা সবাই কলিগ। কৈলাসহর রামকৃষ্ণ মহাবিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিষয়ের শিক্ষক শিক্ষিকা।
———
বিলের পাড়ে আমরা আলোচনায় বসে গেলাম। বিলটির নতুন নামকরণ করলাম ইন্দ্রসাগর। আর মাঝখানের দ্বীপটির নাম দিলাম মধ্যদ্বীপ।
————–
ইন্দ্র সাগরের মাঝখানে মধ্যদ্বীপ আর সাগর বেষ্টিত নীল পাহাড়। এই নামকরণের সাথে সাথেই আমার কল্পনার পানসি নৌকো পেছন পানে চলতে শুরু করলো। আমি সেই পানসি নৌকো চড়ে ফিরে গেলাম বহু যুগ পেছনে……..।
—————-
ইন্দ্রসাগর যে গ্রামে অবস্থিত সেই গ্রামটির নাম রাঙাউটি। একদম কৈলাসহরের উত্তরপ্রান্তে বাংলাদেশের নৌমোজা বর্ডারে অবস্থিত। অবিভক্ত ভারতে আমাদের ত্রিপুরা ছিল রাজন্যশাসিত। ত্রিপুরা, কুমিল্লা,শ্রীহট্ট,হেড়ম্বরাজ্য পাশাপাশি থাকায় এখানকার গল্পগুলো ও পরস্পরের সাথে সম্পর্কিত।
————
আমার কল্পনার পানসি নৌকো পৌঁছে গেলো রাজার যুগে। রাজা ইন্দ্রমানিক্য ছাম্বুলনগর জনপদের রাজা। (আমরা সবাই জানি যে, কৈলাসহরের পূর্বতন নাম ছিলো ছাম্বুলনগর।)
তাঁর রাজধানী রাঙাউটি। তিনি রাঙাউটিতে তৈরী করলেন পোড়াইটের রাজপ্রাসাদ।রাজপ্রাসাদের চারদিকে মাটির দেওয়াল। গ্রামের মানুষের জলকষ্ট দূর করার জন্য খনন করলেন দীঘি। যা,রাজার দীঘি নামে পরিচিত। দীঘিতে স্নান করার জন্য নির্মান করলেন পাকা ঘাট। নিজের নামে প্রচলন করলেন মুদ্রা। নাম দিলেন গজসিক্কা। রাজা ইন্দ্রমানিক্যের আরেকটি নাম ছিলো –পাঁচকড়ি ঠাকুর।
একসময় ইন্দ্রমানিক্য সমশের গাজী নামক এক অত্যাচারী জমিদারের ভয়ে পলায়ন করতে করতে হেড়ম্বরাজ্যে পৌঁছে যান। সেখানে কিছুদিন থাকার পর পরিবার পরিজনদের নিয়ে চলে আসেন ছাম্বুলনগর। ছাম্বুলনগরে রাঙাউটিতে তাঁর পূর্বপুরুষেরা একসময় ছন বাঁশ দিয়ে গৃহ নির্মান করে বাস করতো। সেই বাঁশের ঘরে আশ্রয় নিয়েই তিনি পোড়া ইট দিয়ে তৈরী করলেন রাজপ্রাসাদ। তিনি যখন এই অঞ্চলে আসেন তখন এখানে কুকীদের অত্যাচার প্রকট আকার ধারণ করেছিল। হিংস্র কুকীরা হত্যা,অপহরণ লুন্ঠন,অগ্নিসংযোগ এবং যুবতী নারীদের অপহরণ ইত্যাদি ঘৃণ্য কাজ করতো।এর ফলে জনমনে প্রবল ত্রাসের সৃষ্টি হয়। রাজার সেনা বাহিনী তাদের খুঁজে খুঁজে হয়রান হোত। কারণ তারা মনু নদীর পাড়ে গর্তে লুকিয়ে থাকতো। সেই সময় খাচাক নামে আরেকটি জঙ্গি গোষ্ঠীও খুব আক্রমনাত্মক হয়ে উঠেছিলো।
——–
ইন্দ্রমানিক্য,জঙ্গী আক্রমণ ও মোগলদের আক্রমণের ভয়ে অতিষ্ট হয়ে উঠেন। রাজবাড়ির চারদিকে প্রাচীর তৈরী করেও তার মনে শান্তি ছিলো না।তিনি বেশিদিন এই অঞ্চলে থাকেন নি।শোনা যায় মাত্র ছ’বছর তিনি রাঙাউটিতে ছিলেন। সপ্তদশ শতাব্দীতে ছাম্বুলনগরে ভীষণ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। বহু মানুষ না খেতে পেয়ে মারা যায়।মহামারীও শুরু হয়। দুর্ভিক্ষ, মহামারী,জঙ্গীআক্রমণ —ইত্যাদি কারণে তিনি রাঙাউটি ত্যাগ করে গোমতীর অববাহিকায় চলে যান।
———
ইন্দ্রমানিক্যের ছোটভাই কৃষ্ণমানিক্য ও কিছুকাল রাঙাউটির রাজবাড়িতে ছিলেন। কিন্তু তিনিও জঙ্গীদের হিংস্রতায় ভীত হয়ে রাঙাউটি ছেড়ে হেড়ম্বরাজ্যে চলে যান। হেড়ম্বরাজ্যে থাকার সময় ই তিনি শুনতে পান, মুর্শিদাবাদের নবাব ইন্দ্রমানিক্যকে বন্দী করেছে এবং বন্দী অবস্থায় তার মৃত্যু হয়েছে।
—-খ্রীষ্টীয় সপ্তম শতাব্দী র ধর্মপাল থেকে আরম্ভ করে ত্রিপুরার ১৭৩তম রাজা কৃষ্ণমানিক্য পর্যন্ত অনেক রাজা,ক্ষণিক সময়ের জন্য হলেও রাঙাউটিতে এসে থেকেছেন।
————
আমার কল্পনার পানসি নৌকো রাজাদের আমল পরিভ্রমণ করে আবার ইন্দ্রসাগরের জলে অবগাহন করতে লাগলো।………
রাজা ইন্দ্রমানিক্য তাঁর পরমাসুন্দরী রানীকে নিয়ে ইন্দ্রসাগরের জলে নৌকো বিহার করছেন। নৌকা চলতে চলতে নীল পাহাড়ের নীচে এসে ঠেকলো। সাগরের জলে ফুটে আছে গোলাপী শাপলা ফুল। জলে ভেসে চলেছে জলজ শ্যাওলা র গভীর আস্তরণ।
রাজার নৌকো পাহাড়ের গায়ে ঠেকতেই রানী ভয়ে আঁতকে উঠলেন। গভীর জঙ্গল, সবুজ বড়বড় গাছ। জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসতে পারে শৃগাল,বাঘ,হাতি বা বিষধর সাপ। রানী রাজাকে বললেন তাড়াতাড়ি নৌকো ফিরিয়ে নিয়ে চলতে। ইন্দ্রমানিক্য পাহাড়ের গভীরতায় নিজেকে হারিয়ে ফেলেছেন। এমন সময় হিংস্র কুকী বাহিনী জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এলো। তাদের হাতে ধনুক, তীর,বল্লম। রাজাকে, রানীকে তারা নৌকা র সাথে বেঁধে ফেললো। রানীর গায়ের অলংকার ছিনিয়ে নিলো। রানীর আর্তচিৎকারে জঙ্গল কেঁপে উঠছে। রাজার দেহরক্ষী সেনারা একটু পেছনে ছিলো।রানীর চিত্কার শুনে তারা তারা নৌকো নিয়ে পৌছে গেলো নিমেষে।বেঁধে গেলো যুদ্ধ।অবশেষে জঙ্গীরা পালিয়ে গেলো।রাজা,ও রানীকে নিয়ে নৌকো ফিরলো রাজ বাড়িতে।
———-
ইন্দ্রসাগরের পাড়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এমন ই এক কল্পলোকের গল্পের সাথে আমি অবগাহন করতে লাগলাম।
Leave a Reply