– দীপক সাহা (পশ্চিমবঙ্গ)
২০০৪ সালে বিবিসি বাংলা একটি ‘শ্রোতা জরিপ’-এর আয়োজন করে। বিষয়টি ছিলো – সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি কে? তিরিশ দিনের ওপর চালানো জরিপে শ্রোতাদের ভোটে নির্বাচিত শ্রেষ্ঠ ২০ জনের জীবন নিয়ে বিবিসি বাংলায় বেতার অনুষ্ঠান পরিবেশিত হয় ২০০৪-এর ২৬শে মার্চ থেকে ১৫ই এপ্রিল পর্যন্ত। বিবিসি বাংলার সেই জরিপে শ্রোতাদের মনোনীত শীর্ষ কুড়িজন বাঙালির তালিকায় দশম স্থানে আসেন যুগ প্রবর্তক রাজা রামমোহন রায়। মানুষের জীবন দেশ ও কাল দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। কিন্তু দেশ ও কালের প্রভাবকে স্বীকার করেও যিনি উত্তীর্ণ হন তিনিই মহাপুরুষ। জাতিগত, ধর্মগত, ভাষাগত, সমাজগত, রাষ্ট্রগত বহু সংস্কারের বর্ম ভেদ করে বিশ্বের দরবারে মুক্ত আলোকে এসে দাঁড়ান মহামানব। কঠিন সংগ্রামের কণ্টকাকীর্ণ পথ অতিক্রম করে যিনি এসেছেন তিনি চিরমানব। তাঁদেরই অন্যতম রাজা রামমোহন রায়। ভারতপথিক রামমোহন রায় সনাতন সামন্ততান্ত্রিক দর্শনের যুক্তিসিদ্ধ বিরোধিতা করে ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রবক্তারূপে প্রথম আধুনিক ভারতীয় মানুষ হিসেবে স্মরণীয় হয়ে রয়েছেন।
পলাশির যুদ্ধের (১৭৫৭) মাত্র পনের বছর পরে কলকাতা থেকে প্রায় ১২০ কিলোমিটার দূরে হুগলির রাধানগর গ্রামে ১৭৭২( মতান্তরে ১৭৭৪) সালের ২২ মে জন্মগ্রহণ করেন রামমোহন রায়। পিতা রামকান্ত রায় এবং মা তারিণী দেবী।
পঞ্চদশ শতাব্দিতে ইটালিতে যে নবজাগরণ হয় তা যেমন কালে কালে সমগ্র ইউরোপে পরিব্যাপ্ত হয়েছিল। অনুরূপ উনবিংশ শতকের প্রথমার্ধে পাশ্চাত্য শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সভ্যতার সংস্পর্শে এসে বাংলার সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় জীবনে পুনরায় যে নতুন জাগরণ সৃষ্টি হয়, তাকেই বাংলার নবজাগরণ বলা হয়। বাংলার নবজাগরণ তেমনি ক্রমে ক্রমে সমগ্র ভারতভূমিকে প্লাবিত করেছিল। পেত্রার্ক ও বোকাচ্চিও যেমন ইটালির নবজাগরণের অগ্রদূত ছিলেন তেমনি পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত রামমোহন ছিলেন বাংলা তথা ভারতীয় নবজাগরণের অগ্রদূত। রামমোহন রায় পরিচালিত সংস্কার আন্দোলনে যুক্তিবাদী ও মানবতাবাদী চেতনার প্রতিফলন পড়েছিল। সামাজিক দাসবুদ্ধির হাত থেকে তিনি বাঙালিকে মুক্তি দেবার জন্য সচেষ্ট হয়েছিলেন। প্রচলিত সামাজিক কুসংস্কার ও গোঁড়ামির অপসারণ করে তিনি সমাজ জীবনকে কলুষ মুক্ত করতে চেয়ে ছিলেন। ধর্ম ও সমাজ সংস্কারক, রাজা রামমোহন রায় ভারতের নবজাগরণের পথিকৃৎ।
সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার প্রবক্তা এবং মানবকল্যাণকামী এই মহান মানুষটি আজও নতুন প্রজন্মের কাছে সমান প্রাসঙ্গিক। দেশ ও জাতি গঠনে তাঁর যে অবদান –বর্তমানকালের রাজনৈতিক, আর্থিক, সামাজিক, ধর্ম ও শিক্ষা সংস্কারে এখনও সে সকল প্রাসঙ্গিকতা ফুরিয়ে যায় নি। রামমোহনের প্রকৃত মূল্যায়ন বাঙালি করে নি। সেই কবে প্রথম বাঙালি সমাজবিজ্ঞানী অক্ষয়কুমার দত্ত আক্ষেপ করে লিখেছেন, “……কেহ কি আজও তোমাকে (রামমোহন রায়কে) চিনিল? জীবদ্দশায় তোমাকে আমরা স্বীকার করি নাই, মৃত্যুর পরেও আমরা তোমার প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করিব না। এমনই অপদার্থ আমরা ! ” রাজা রামমোহন রায়ের জন্মের আড়াইশো বছরের দোরগোড়ায় এসেও অক্ষয়কুমার দত্তের আক্ষেপ এখনও আমাদের মননে অনুরণিত হয়।
বহুভাষাবিদ,শাস্ত্রজ্ঞানী, প্রবল যুক্তবাদী, ব্যক্তিস্বাধীনতাকামী, অনন্য আন্তর্জাতিকতাবাদী রামমোহন রায় নরোত্তমই থেকে গেলেন। দেবত্ব বা পূর্ণ-ব্রহ্মত্ব লাভ করে ‘পুজো’ পাবার অবকাশ পেলেন না। তিনি মানুষই থেকে গেলেন এবং সেইজন্য আমরা তাঁকে মানুষের মতো করেই দেখে এসেছি, তাতে তাঁর মর্যাদার হানি হয়নি। রবিঠাকুর চারিত্রপুজা প্রবন্ধে যথার্থই বলেছেন,” বর্তমান বঙ্গসমাজের ভিত্তি স্থাপন করিয়াছেন রাজা রামমোহন রায়। আমরা সমস্ত বঙ্গবাসী তাঁহার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী, তাঁহার নির্মিত ভবনে বাস করিতেছি।…….. আমাদের যদি কেহ বাঙালি বলিয়া অবহেলা করেন আমরা বলিব, রামমোহন রায় বাঙালি ছিলেন।”
Leave a Reply