মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ০১:২১ অপরাহ্ন

শিরোনাম :
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ (কসবা-আখাউড়া) আসনে আইন মন্ত্রী আনিসুল হক বে-সরকারি ভাবে নির্বাচিত কসবায় ভোট দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ১ আহত-৪ কসবায় এলজিইডি’র শ্রেষ্ঠ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠান আগরতলায় স্রোত আয়োজিত লোকসংস্কৃতি উৎসব কসবা প্রেসক্লাব সভাপতি’র উপর হামলার প্রতিবাদে মানবন্ধন ও প্রতিবাদ সভা কসবায় চকচন্দ্রপুর হাফেজিয়া মাদ্রাসার বার্ষিক ফলাফল ঘোষণা, পুরস্কার বিতরণ ও ছবক প্রদান শ্রী অরবিন্দ কলেজের প্রথম নবীনবরণ অনুষ্ঠান আজ বছরের দীর্ঘতম রাত, আকাশে থাকবে চাঁদ বিএনপি-জামাত বিদেশীদের সাথে আঁতাত করেছে-কসবায় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ১৩ দিনের জন্য ভোটের মাঠে নামছে সশস্ত্র বাহিনী
শস্যভান্ডার খ্যাত নওগাঁর সাপাহারে এখন আমের রাজত্ব

শস্যভান্ডার খ্যাত নওগাঁর সাপাহারে এখন আমের রাজত্ব

ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম।।

উত্তরবঙ্গের ইতিহাস ও ঐতিহ্যখ্যাত জেলা নওগাঁ এক সময় ছিল গাঁজা চাষের জন্য সমৃদ্ধ। ১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দের পর থেকে কালের আবর্তন ও বিবর্তনে এই চাষাবাদ ও উৎপাদন চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে পড়ে। এর পর থেকে কৃষি ও কৃষজাত পণ্য উৎপাদনের পাশাপাশি ধান উৎপাদনের ক্ষেত্রেও এ জেলার নাম ওঠে আসে শীর্ষ অবস্থানে। বিশেষত ধান-চাউল উৎপাদন ও রপ্তানিকরণের ক্ষেত্রে জেলাটি দেশের মানচিত্রে অনন্য আবেদনে সহসায় সুপরিচিত লাভ করেছে। বর্তমানে কৃষি ও কৃষিজাত পণ্যের পাশাপাশি জেলায় নতুনভাবে সংযুক্ত হয়েছে আমচাষ ও আমচাষির কথা। দেশে যত ধরনের আম উৎপাদিত হয় তার প্রায় সব ধরন ও আকৃতি-প্রকৃতির আম উৎপাদিত হয় জেলার নির্দিষ্ট এই অঞ্চলটিতে। তবে নির্দিষ্ট অঞ্চল বলতে বিশেষত সাপাহার, পত্নীতলা, পোরশা ও নিয়ামতপুর উপজেলাকে বোঝানো হয়। এই অঞ্চলটিতে আম চাষ এতটায় বৃদ্ধি পেয়েছে যে সরেজমিন আপনি দেখলে আনন্দে অভিভূত হয়ে পড়বেন। ধানের জমিতে এখন উৎপাদিত হয় আম। বিগত একদশক পূর্বে যে ভূমিতে উৎপাদিত হতো ধান, আজ সেখানে উৎপাদিত হয়ে চলছে কেবল আম আর আম।
আমচাষ খুব লাভজনক হওয়ায় সম্প্রতি অঞ্চলটির কৃষকসমাজ আমচাষের দিকে অধিক মাত্রায় ঝুঁকে পড়েছেন। গত কয়েক বছর ধরেই এখানে গুটি আম, ফজলি, লক্ষণাভোগ, ক্ষীরশাপাত, ল্যাংড়া, গোপালভোগ, আম্রপালি (রূপালী), হিমসাগর, আশ্বিনা ও বারি-৪ এবং হাঁড়িভাঙা আমের চাষ হয়ে আসছে। দেশব্যাপী মানুষ তাদের পূর্বের ধারণা অনুয়ায়ী এখনো চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলাকে আমের রাজধানী হিসেবে মনে করেন। মানুষের মনের ধারণাকে অতিক্রম করে এই অঞ্চলটিতে যেভাবে ব্যাপকহারে আমের চাষাবাদ হচ্ছে তা দেশবাসীর নিকট এখনো অজানা রয়েছে। আমচাষের দিক থেকে জেলার সাপাহার অঞ্চলটি অধুনা চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলাকেও অতিক্রম করেছে। বিশেষত জেলার সাপাহার ও পোরশা উপজেলায় বিভিন্ন জাতের যেসব আম উৎপাদিত হয় তা চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমের চেয়ে গুণে ও মানে কোনো অংশে কম নয়। এখানকার আমের আকৃতি ও গঠনগত অবয়ব কেবল দেখতেই সুন্দর ও আকর্ষণীয় তাই-না, বরং তা খেতেও খুব সুস্বাদু। গত কয়েক বছর থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের মানুষ আমের মৌসুমে সাপাহার এসে টন-কে-টন আম কিনে শত শত ট্রাকে নিয়ে গেছেন এবং এখনো এ ধারা অব্যাহত আছে। কৃষিবিদ ও কৃষিসম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ও গবেষকদের মতে এখানকার মাটি আমচাষের জন্য খুবই উপযোগী। ফলে এখানকার মাটি আমচাষের উপযোগী হওয়ায় কারণে এই চাষাবাদ দিন দিন বেড়েই চলছে। আর আমচাষ খুব লাভজনক একটি ফসল হওয়ার কারণে মানুষ এখন ধানের চাষাবাদ ছেড়ে দিয়ে আমচাষের দিকে অধিক হারে ঝুঁকে পড়েছেন।

অঞ্চলটির বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে আম চাষিদের সাথে সরেজমিন কথা বলে জানা গেছে, বিগত কয়েক বছর ধরে ধানের বাজারে মুনাফা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ধস নামে। ফলে চাষিদের দুশ্চিন্তার পাশাপশি চরম লোকসানে পড়তে হয়। এমন প্রেক্ষিতে অধিকাংশ চাষি হতাশাগ্রস্ত হয়ে দুর্বিষহ জীবনে পড়ে অনাগত ভবিষ্যতের ভাবনায় চিন্তিত হয়ে পড়েন। ধান চাষ করে লোকসানের কবলে পড়ার কারণে চাষিরা ধানচাষের ক্ষেত্রে পুরোমাত্রায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। এমতাবস্থায় তাঁরা চরম ক্ষতির সম্মুখীন হন। ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার আশায় ধানের চাষ বাদ দিয়ে বিকল্প কোনো চাষের জন্য প্রচেষ্টা গ্রহণ করেন। এই প্রচেষ্টার ফল স্বরূপ ধানচাষের জমিতে ধানের পরিবর্তে বিভিন্ন জাতের আমচাষ শুরু করেন। পরীক্ষামূলকভাবে এই চাষ ছিল সীমিত পরিসর নিয়ে। পরবর্তীতে স্বল্প পরিসরের চাষাবাদে অধিক সাফল্য হাতে পাওয়ায় চাষিদের মধ্যে আগ্রহের সৃষ্টি হয়। ইতিমধ্যে তাঁরা জেনে যান আমচাষ একটি লাভজনক ফসল। তাই অনাগত ভবিষ্যতকে সামনে রেখে লাভবান হওয়ার আশায় অঞ্চলটির কৃষকরা এই আবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েন। আপদ ও বালাইয়ের দিক থেকে আমচাষ অনেকটা ঝুঁকিমুক্ত হওয়ার কারণে ক্রমান্বয়ে চাষিরা এই আবাদের দিকে নজর দিয়েছেন। এছাড়াও খরচের তুলনায় ধানচাষের চেয়ে আমচাষে কয়েক গুণ টাকা লাভ হয়ে থাকে। ফলে এলাকায় আমবাগানের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকে।

বর্তমানে এই অঞ্চলের উৎপাদিত আম সংরক্ষণের কোনো পদ্ধতি বা প্রক্রিয়া গড়ে ওঠেনি। উৎপাদিত আম সংরক্ষণ করতে না পারাকে বড় সংকট হিসেবে অঞ্চলটির মানুষ মনে করেন। তাই এলাকার মানুষের দাবি জরুরি ভিত্তিতে এই কৃষিজাত পণ্যটির সংরক্ষণ বা রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক। এখন আম সংরক্ষণের জন্য প্রযুক্তিগত চাহিদার সম্ভাব্যতা জরুরি হয়ে পড়েছে। এই সংরক্ষণ সরকারি বা বেসরকারি যে কোনো উপায়ে হতে পারে। এখানকার উৎপাদিত আম বিদেশেও রপ্তানির সম্ভ্যতা দেখা দিয়েছে। অঞ্চলটির উৎপাদিত বিভিন্ন প্রজাতির সুস্বাদু আমগুলো যদি বিদেশে রপ্তানি করা যায়, তাহলে শতশত কোটি টাকার মুনাফা বা রেমিট্যান্স আহরণের সম্ভাব্যতা দেখা দিবে এমন আশাবাদ ব্যক্ত করা অমূলক নয়। তাই এখানে একটি কৃষিগবেষণা স্থাপনের জন্য অঞ্চলটির মানুষ সরকারের সুনজর ও সহানুভূতি কামনা করেন। অঞ্চলটিতে কৃষিগবেষণা স্থাপনের বিষয়টি এখন তাই সময়ের দাবি। কেবল আম উৎপাদনের ক্ষেত্রেই নয়, এই জেলা কৃষি ও কৃষিজাত পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রেও শীর্ষে রয়েছে। বিধায় জেলায় কৃষিগবেষণা স্থাপনের বিষয়টি যৌক্তিকতার দাবিদার। এছাড়াও কৃষকরা যেন তাঁদের উৎপাদিত পণ্যের নায্যমূল পান সে বিষয়টির প্রতি নজর রাখা প্রয়োজন। সেই সাথে করোনাকালীন সময়ে উৎপাদিত আমগুলো যেন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে পৌঁছাতে পারে সেদিকেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজর দেওয়া প্রয়োজন বলে অঞ্চলটির আমচাষিরা মনে করেন।

বাংলা জ্যৈষ্ঠ মাস থেকে শুরু হয়ে চলে ভাদ্রমাস পর্যন্ত আমের কেনাবেচা। গাছের আম পেকে যাওয়ার সাথে সাথেই গাছ থেকে নামানো হয় আম। আর অঞ্চলটির নামানো আমসমূহ সাপাহার বাজারে অবস্থিত শত শত আমের আড়তে তা মণ দরে বিক্রয় করা হয়। অবশ্য একই প্রজাতির আম হওয়ার পরেও অনেক ক্ষেত্রে ধরন ও রকম অনুসারে বিভিন্ন দরদামে তা বিক্রয় করা হয়। আরও উল্লেখ্য যে, একেক প্রজাতির আম একেক সময়ে বাজারে আসে। ফলে দরদামের ক্ষেত্রে ভিন্নতা থাকার বিষয়টি সমীচীন হয়ে পড়ে। সাপাহার বাজারে এসে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত ও জেলা থেকে আগত শত শত ব্যাপারি ও পাইকাড়রা ট্রাকে লোড করে আমসমূহ নিয়ে যান। দেশে এতোবড় পাইকারি আমের বাজার আর কোথাও আছে বলে মনে হয় না। অবশ্য একেক প্রজাতির আম একেক সময় নামাতে হয়। কারণ হিসেবে সময় ডিউরেশন একটি মুখ্য বিষয়। মনে রাখা প্রয়োজন যে, সব আম একসাথে পেকে ওঠে না। সময় অনুসারে বিভিন্ন প্রজাতির আম গাছে পেকে থাকে। যখন যে আম গাছে পেকে ওঠে তখনই মনে করা হয় সে আমটি নামানোর সময় হয়েছে। তবে গাছে আম পেকে ওঠার আগে সাধারণত আম নামানো হয় না।
আম ভক্ষণের বিষয়ে কোন আম কখন খাবেন সে বিষয়ে পাঠক ও ভোক্তার একটি ধারণা থাকা প্রয়োজন। এ বিষয়ে পাঠক বা ভোক্তাকে ধারণা প্রদানের জন্য একটি পরিসংখ্যান উল্লেখ্য। গুটি আম ১৫ মে, গোবিন্দভোগ ১৫ মে, কালিভোগ, ২২ মে, গোপালভোগ ২০ মে, লক্ষণাভোগ ২৫ মে, রানীপছন্দ ২৫ মে, হিমসাগর ২৮ মে, ক্ষীরশাপাত ২৮ মে, ল্যাংড়া ৬ জুন, ফজলি ১৫ জুন, আম্রালি (রূপালি) ১৫ জুন, হাঁড়িভাঙা ২০ জুন, বারি-৪ আম ১০ জুলাই, আশ্বিনা, ১০ জুলাই পরবর্তী নামানোর উপযুক্ত সময়। তবে এই সময়ের ফ্রেমটি অনেক ক্ষেত্রে আবহাওয়া ও জলবায়ুরে উপর নির্ভরশীল হয়। এ ক্ষেত্রে অন্তত পক্ষে এক সপ্তাহের একটি ব্যবধান বা হেরফের পরিলক্ষিত হয়। তবে ভোক্তা বা সাধারণ মানুষের অবগতির জন্য সময়ের এমন ফ্রেমটি প্রাথমিক একটি ধারণা আহরণে সহায়ক হিসেবে গ্রহণীয়।

ধানের জন্য বিখ্যাত জেলা নওগাঁর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মূল চাবিকাঠি হলো কৃষি ও কৃষিনির্ভর ফসলাদি। নওগাঁর কাটারিভোগ, কালাজিরা চালসহ উন্নতমানের চালের জন্য এই জেলা দেশের মানচিত্রে বিশেষভাবে পরিচিত। এছাড়াও ধানচাষ নির্ভর এই জেলা দেশের সিংহভাগ চালের যোগানদাতা। চাউল উৎপাদনে বিশেষ পরিচিত এ জেলায় অল্প সময়ের ব্যবধানে ঘটেছে আমের বিপ্লব। ধানচাষের পরিবর্তে আমচাষ বিষয়ে চাষিরা বলেন, ধানের চাইতে আম উৎপাদনে বেশি লাভ হয়, তাই কৃষকরা আম চাষে ঝুঁকে পড়েছেন। সার, বীজ, মজুরি এবং কীটনাশ প্রয়োগ করার পর ধান উৎপাদনে লাভ থাকে না। পক্ষান্তরে আমচাষে সহজে বেশি লাভবান হওয়া যায়। যার ফলশ্রুতিতে ফসলের জমিতে দিন দিন আমবাগান বাড়ছে। সরেজমিন দেখা গেছে, অঞ্চলটিতে চলছে রীতিমত ফসলি জমিতে আমবাগান বানানোর তীব্র প্রতিযোগিতা। আর এই প্রতিযোগিতার অন্যতম কারণ হিসেবে পাওয়া যায় অল্প খরচে অধিক মুনাফা লাভ বা মোটা অংকের টাকা প্রাপ্তি। বলা চলে এ কারণে অঞ্চলটিতে আম উৎপাদনের ক্ষেত্রে ঘটেছে এক ধরনের সামাজিক বিপ্লব। আর এই বিপ্লবের অন্যতম কারণ হিসেবে পাওয়া যায় সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত অঞ্চলটির বিরাজমান মাটির গুণাগুণ। মাটির কারণে আম উৎপাদনে বেশ ভালো ফলন পাওয়া যায়। স্বাদ এবং গুণমানে অধিক ভালো হওয়ার কারণে দেশের বাজারে এই অঞ্চলটির আমের চাহিদা অধিক।

ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম
গবেষক, প্রাবন্ধিক, ইতিহাসজ্ঞ
এবং
সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, বাংলা বিভাগ, নওগাঁ সরকারি কলেজ, নওগাঁ

এই সংবাদটি শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




raytahost-demo
© All rights reserved © 2019
ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: Jp Host BD