পাভেল আমান
একটি দেশ, জাতি তথা রাষ্ট্রের প্রগতির ও উত্তরণের সর্বজনবিদিত বাহক হচ্ছে বিজ্ঞান, বিজ্ঞান চর্চা, বিজ্ঞানচেতনা ,বিজ্ঞানমনস্কতা। বর্তমান মানব সভ্যতার অগ্রগতির চাবিকাঠি হচ্ছে বিজ্ঞান। ভুবন ব্যাপী যে সমস্ত দেশগুলো উন্নতির সোপান বেয়ে সম্মুখে ধাবমান তাদের প্রধান ভিত্তি বিজ্ঞানের সার্বিক প্রসার, প্রয়োগ ও চাহিদা। একটি কথা স্পষ্টই বলা যায় বিজ্ঞান ও প্রগতি একে অপরের পরিপূরক। আমাদের ভারতবর্ষেও জন্মেছিলেন প্রথিতযশা বিজ্ঞানীরা যারা আজীবন নিরলস বিজ্ঞান সেবাই নিবেদিতপ্রাণ থেকে দেশ জাতিও যুবসমাজকে বিজ্ঞান মুখী, বিজ্ঞান অনুরাগী, বিজ্ঞান মনস্ক হতে উৎসাহিত করেছে। তাদের বিজ্ঞানচেতনা, বিজ্ঞান সাধনা, বিজ্ঞান ভাবনা, বিজ্ঞান দর্শন, বিজ্ঞান নির্ভর জীবন ও সর্বোপরি আবিষ্কার, উদ্ভাবন সুষ্ঠুভাবে বিজ্ঞানের প্রভাব, পরিসর, উপযোগিতা, জনপ্রিয়তা দিনকেদিন ক্রমবর্ধমান। আমরা সবাই অবগত
১৯২৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি তারিখে ভারতীয় পদার্থবিদ চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রমন ‘রমন এফেক্ট’ আবিষ্কার করেছিলেন। তিনি সি ভি রমন নামে বেশি পরিচিত। তাঁর এই উল্লেখযোগ্য ও যুগান্তকারী আবিষ্কারের জন্য ১৯৩০ সালে পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান। সি ভি রমন শুধু ভারতের নন, গোটা এশিয়ার মধ্যে প্রথম ব্যক্তি যিনি পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন।এই আবিষ্কারকে সম্মান জানিয়েই ১৯৮৬ সাল থেকে এই দিনটি জাতীয় বিজ্ঞান দিবস হিসাবে পালিত হচ্ছে।গোটা দেশজুড়ে বিভিন্ন বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়, অন্য অন্য শৈক্ষিক, বৈজ্ঞানিক, কারিগরী, চিকিৎসা, গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহে এই দিন পালন করা হয়।এবারে আসা যাক সি ভি রমন এই আবিষ্কার সম্পর্কে আলোচনায়।১৯২১ সালে এক বার জাহাজে করে তিনি লন্ডন থেকে দেশে ফিরছিলেন। খেয়াল করলেন সমুদ্রের জলের রং নীল। তিনি জানতেন আকাশের রংও নীল লাগে, কারণ আকাশের বিশেষ বর্ণ ছটার জন্য। কিন্তু সমুদ্রের রং কেন নীল লাগে! সেই ভাবনা থেকেই তিনি গবেষণা শুরু করেন। আর তার ফলাফল জগৎবাসীর সামনে স্পষ্ট। সেটাই ‘রমন এফেক্ট’ নামে পরিচিত। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না রমন এফেক্ট আলোকতরঙ্গের অজানা পথ খুলে দিয়েছে। শক্তির স্তর এবং অণু ও পরমাণুর গঠন বুঝতে অনেক সহায়তা করেছে। পদার্থবিজ্ঞানের অনেক শাখায় রমন এফেক্ট কাজে লাগছে। জীববিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসাবিজ্ঞানেরও অনেক শাখায় রমন এফেক্ট কাজে লাগিয়ে অনেক নতুন নতুন গবেষণা হচ্ছে।লম্বা গবেষণার পর অবশেষে ১৯২৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি তিনি সূত্র আবিষ্কার করেন। অবশ্য ১৬ মার্চ আনুষ্ঠানিক ভাবে এই সূত্র প্রকাশ করেন তিনি। এই সূত্রের মূল কথা হল, পদার্থের বিভিন্ন অণুপরমাণুই সেই পদার্থের বর্ণের প্রতিফলনের জন্য দায়ি, তা সে জল, মাটি, আকাশ বা যা কিছুই হোক না কেন। কোন বস্তুকে কী রঙের দেখাবে তা তার ওপরই নির্ভর করে।দিনটি পালনের মূল উদ্দেশ্যই হল- জনগণের দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞানের গুরুত্ব সম্পর্কে বার্তা প্রচার, বা বলা ভাল জনগণকে বিজ্ঞান বিষয়ে উৎসাহিত করা। সাধারণ মানুষের মধ্যে বিজ্ঞান বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে, প্রাত্যহিক জীবনের বিজ্ঞানের গুরুত্ব আর প্রয়োজনীয়তা কী তা তুলে ধরার জন্য আর নতুন প্রজন্মকে বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কারের প্রতি আগ্রহী করে তোলার জন্য বিবিধ নীতি, কর্মসূচি রূপায়ন করা।পাশাপাশি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জনপ্রিয় করতেও এই দিনটির বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। তাছাড়া মানবকল্যাণে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে সমস্ত রকমের কার্যক্রম, প্রচেষ্টা এবং সাফল্যের প্রদর্শনও করা হয়ে থাকে এই দিনটিতে। অন্যদিকে বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়নের জন্য সমস্ত বিষয় নিয়ে আলোচনা এবং নতুন নতুন প্রযুক্তি বাস্তবায়নের জন্যও উদযাপিত হয়ে থাকে এই দিনটিতে।বিভিন্ন স্কুলের পড়ুয়াদের জন্য নানান রকম বিজ্ঞান বিষয়ক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। তাদের এক্সিবিশন, তাৎক্ষণিক বক্তৃতা, বিতর্কসভা, আলোচনার আয়োজন করা হয়। পরিশেষে করোনা সংকটের থেকে আমাদের বেঁচে থাকতে, সুস্থভাবে জীবনযাপন করতে প্রতিনিয়ত বিজ্ঞান অনুসরণ, বিজ্ঞান কেন্দ্রিক চিন্তাভাবনা, বিজ্ঞানকে মেনে চলা একান্ত জরুরী। একমাত্র বিজ্ঞানই পারে সমস্ত কুসংস্কার, অযৌক্তিক ধারণাকে ভেঙে চুরমার করে যুক্তি বাদী হয়ে জীবন কাটাতে। বিজ্ঞান তো আলোর দিশারী। অন্ধকার যুগ থেকেই আলোর যুগে বিজ্ঞানের হাত ধরেই আমরা এসেছি। প্রতিনিয়ত সংগ্রহ করেছি জীবন ধারণ এবং গড়ার মন্ত্র। বিজ্ঞানীই তো আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে সত্য ও মিথ্যার তফাৎ যুক্তি ও সঠিক প্রমাণের দ্বারা সবকিছুর বিচার-বিশ্লেষণ ,উপস্থাপন ও প্রতিস্থাপন। চিকিৎসাশাস্ত্র থেকে অর্থনীতি,সমাজবিজ্ঞান থেকে রাজনীতি সর্বক্ষেত্রেই বিজ্ঞান ছাড়া পঙ্গু। অতিমারির এই আবহে জীবন জীবিকার স্বার্থে নিউ নরমালে আমরা এখনো জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিজ্ঞানকে মেনে চলার সাহস রাখি। বিজ্ঞান আমাদের সবসময়ের সুখে দুখের নিয়ত সাথী।৩৪তম বিজ্ঞান দিবসে পদার্থবিজ্ঞানী চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রমনের কর্মমুখীন বিজ্ঞান জীবনকে অনুসরণ ও তার আবিষ্কার রমন ইফেক্টকে আরো বেশি প্রসার,মানব কল্যাণে প্রয়োগ করার পর ইচ্ছা পোষণ করি এবং জনমানসে বিজ্ঞানচেতনা, বিজ্ঞান প্রসার, বিজ্ঞান মনস্কতা,বিজ্ঞান ভাবনা প্রতিনিয়ত ছড়িয়ে দিতে, চারিয়ে দিতে সর্বদা সদর্থক ভূমিকা পালন করি। তবেই আমাদের বিজ্ঞান দিবস পালনের প্রাসঙ্গিকতা, তাৎপর্য ও বাস্তববাদিতা।
পাভেল আমান- হরিহার পাড়া -মুর্শিদাবাদ
Leave a Reply