ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম।।
নওগাঁ জেলার মহাদেবপুর উপজেলার অধীন চেরাগপুর ইউনিয়নের আলীপুর গ্রামে একটি ঐতিহ্যবাহী মাটির দ্বিতল লোকস্থাপনা রয়েছে। মহাদেবপুর উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ঐতিহ্যবাহী এই বসতবাড়ির অবস্থান। নওগাঁ-মহাদেবপুর মহাসড়কের তের মাইল নামক মোড় থেকে নেমে উত্তর দিকে প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরত্বে পাকা রাস্তার পাশে রাজপ্রাসাদের মতো নির্মিত মাটির তৈরি দ্বিতল বাড়িটি সবার নজর কাড়ে। যে কোনো পরিবহন নিয়ে উপজেলা সদর মহাদেবপুর থেকে সরারসরি এই বাড়িতে পৌঁছা যায়। আবার জেলা সদর নওগাঁ থেকেও অনায়াসে পরিবহনযোগে এই বাড়িতে পৌঁছাতে পারেন। জেলা সদর থেকে পশ্চিম-উত্তর দিকে প্রায় ২২ কিলোমিটার দূরত্বে এই বাড়িটি অবস্থিত। বদলগাছী-নজিপুর মহাসড়কের মধ্যবর্তী এক স্থানের নাম মাতাজিহাট। এই মাতাজিহাট থেকে পাড়াসড়ক দিয়ে বিভিন্ন উপায়ে পরিবহন যোগেও গমনাগমন করা যায়। মাতাজিহাট থেকে দক্ষিণ দিকে প্রায় ৯ কিলোমিটার দূরত্বে এই বাড়ির অবস্থান। একুশ বিঘা জমির উপর ২২৫ ফুট লম্বা এই বাড়িটির আয়তন। ২০০ বান টিন দিয়ে তৈরিকৃত দ্বিতল এই বাড়িটিতে ১০৮টি কক্ষ রয়েছে। বিশাল অবয়বের এই বাড়িটির নির্মাতা ছিলেন মো: সমশের আলী মণ্ডল ও মো: তাহের আলী মণ্ডল নামক দুজন ব্যক্তি। ব্যক্তিদ্বয় সম্পর্কের দিক থেকে সহোদর ভাই। মহাদেবপুর উপজেলার অন্তর্গত ১০৮ কক্ষের বাড়িটি মূলত মাটি দিয়ে তৈরিকৃত ঐতিহ্যের এক বিরল দৃষ্টান্ত। প্রায় ৪০ বছর আগে মাটির এই দ্বিতল বাড়িটি নির্মিত হয়েছে। মাটি, পানি, খড় দিয়ে ভিজিয়ে কাদায় পরিণত করে সেই কাদা দিয়ে বাড়িটির দেয়াল নির্মাণ করা হয়েছে। নির্মিত দেয়ালটির আয়তন ২০’-৩০” ইঞ্চি চওড়া। বাড়িটির দেয়াল তৈরি করতে বেশ সময় দিতে হয়েছে। কেননা একইসাথে বেশি উঁচু করে এর দেয়াল গাঁথুনি করা সম্ভব নয়। সর্বোচ্চ দেড় হাত পর্যন্ত উঁচু করে এর দেয়াল একটি পর্বে নির্মিত হয়ে থাকে। একটি দেয়াল গাঁথুনির পর দেয়ালটিকে রোদে শুকিয়ে নেয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। রোদে শুকানোর পর আবার তার উপর একই উচ্চতায় দেয়াল নির্মাণ করা হয়।
সাধারণভাবে মাটির একটি দ্বিতল বাড়ি তৈরি করতে সময় লাগে ৫/৬ মাস। তবে ১৮’-২০” ফুট উঁচু এই বাড়িটি নির্মাণ করতে সময় লেগেছে প্রায় এক বছর। ইটের বাড়ির মতো দ্রুততার সাথে এর দেয়াল নির্মাণ সম্ভব নয়। কারণ এর দেয়াল তৈরির ব্যাপারে সময় একটি বড় বিষয়। কারণ নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত এর দেয়াল তৈরি করতে অপেক্ষায় থাকতে হয়। ২২৫ ফিট লম্বা এই বাড়িটি নির্মাণ করতে বিশাল আকৃতির একটি পুকুরও খনন করতে হয়েছে। কেননা খননকৃত পুকুরটির মাটি দিয়েই এই বাড়িটির দেয়াল নির্মিত হয়েছে। নির্মাণকালীন সময়ে একই দোকান থেকে ২০০ বান টিন ক্রয়ের কারণে দোকানদার দ্বিতল এই বাড়ির মালিককে একটি চায়না ফনিক্স সাইকেল উপহার দিয়েছিলেন। দোকানদার একসাথে ২০০ বান টিন দিতে পারেন নি। ২০০ বান টিন একসাথে দিতে গিয়ে দোকানদার বাড়িওয়ালার কাছে সাতদিন সময় নিয়েছিলেন। বাড়িটির চতুরদিক একবার প্রদক্ষিণ করতে সময় লাগে পাঁচ মিনিট। বাড়িটিতে প্রবেশের ফটক রয়েছে ১১টি। তবে প্রতিটি ঘরে রয়েছে একাধিক দরজা। কোনো কোনো কক্ষে ৪/৫টি পর্যন্ত দরজা রয়েছে। দ্বিতল ভবনে উঠার সিঁড়ি রয়েছে ১৩টি। যে কোনো একটি সিঁড়ি দিয়ে প্রবেশ করে যাওয়া যাবে ১০৮টি কক্ষে। বিশাল আকৃতির এই বাড়িটি প্রধানত তিনটি ভাগে বিভক্ত। বাড়িটিতে বর্তমানে প্রায় ৩5/৪০ জন লোক বসবাস করেন। ১০৮টি কক্ষের মধ্যে সর্বমোট ৩০ থেকে ৩৫টি কক্ষ ব্যবহৃত হয়।
সহোদর ভ্রাতাদ্বয় মূলত শখের বশবর্তী হয়ে তৈরি করেছিলেন এই বসতবাড়িটি। বর্তমান সময়ে মানুষ আর মাটি দিয়ে তৈরিকৃত বাড়ি বানাতে চান না। কেননা মাটির তৈরি বাড়ি প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলার উপযোগী নয়। বিশেষত বন্যা বা জলোচ্ছ্বাস এর অন্যতম কারণ। মাটির তৈরি ঘরগুলো বন্যা, ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিশেষ ক্ষতি সাধিত হয়। সে কারণে মানুষ অধুনা পাকাবাড়ি বা ইট-সিমেন্ট ও রড দিয়ে তৈরিকৃত বাড়ি বানাতে অধিক আগ্রহী। বাড়িটি তৈরির পর এখন এর রক্ষণাবেক্ষণ করার কাজটি প্রধান বিষয় হিসেবে দেখা দিয়েছে। তাই সরকারি বা বেসরকারি উপায়ে যথাযথভাবে বাড়িটির সংরক্ষণ করতে পারলে গ্রামবাংলার প্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্যের নিদর্শন হিসেবে পর্যটকদের জন্য দৃষ্টিনন্দন একটি দর্শনীয় স্থান হিসেবে বাড়িটি ইতিহাসে জায়গা পাবে। বাড়িটির সম্মুখ ভাগে বা পশ্চিম দিকে রয়েছে একটি বিশাল আকৃতির পুকুর। উত্তর দিকে রয়েছে আবদি জমি বা ফসলের ভূমি। পূর্বে রয়েছে খলিয়ান ও প্রশস্ত অঙ্গন। আর দক্ষিণে রয়েছে গাছপালা এবং অপরাপর গ্রামের জনসাধারণের বসতি। সম্প্রতি মাটির তৈরিকৃত এই বাড়িটি দেখার জন্য প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পর্যটকগণ এসে থাকেন।
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম
গবেষক, প্রাবন্ধিক, ইতিহাসজ্ঞ
এবং
সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, বাংলা বিভাগ,
নওগাঁ সরকারি কলেজ, নওগাঁ
Leave a Reply